যে প্রাকৃতিক কারনে এই বিপর্যয় হচ্ছে, সেই
প্রাকৃতিক কারনগুলো তৈরি হওয়ার পেছনে মানুষের হাত রয়েছে। সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা কেউ জোর গলায় কথা
বলছি না। আপত্তি করছি না। যারা হিমালয়ে নিয়মিত যান, অভিযাত্রীরা, এ বিষয়ে সব থেকে
বেশি তাদের বলার আছে। অভিযাত্রীরা কথা বললে সরকার হয়ত নড়েচড়ে বসবে। কখনো হিমালয়
জুড়ে যা ঘটছে তার বিরুদ্ধে কোনও অভিযাত্রীরা কথা বলেন নি। ভারতের প্রাচীন ধর্ম,
সনাতন সব তীর্থস্থান অসাধারণ সব যায়গায় (কয়েকটির বর্ণনা দেন তিনি)। মানুষ হাজার
হাজার বছর ধরে হিমালয় গিয়েছে, নানান সব দুর্গম কিন্তু অসম্ভব সুন্দর স্থান
আবিষ্কার করেছেন। আমরা হিমালয়কে দেবভূমি বলি। কখনো সেই হিমালয়কে তাঁরা ময়লা,
দূষিত, নষ্ট করেন নি। আমাদের প্রাচীন, সভ্যতা প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আঘাত হানত না।
পুরনো ভারতের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন পশ্চিমি ভারত। দুই ভারত একসঙ্গে এগিয়ে চলেছে।
হিমালয়ের সম্পদকে রক্ষা করতেন স্থানীয়রা।
তাঁরা এই সম্পদকে নিয়ে বাঁচতেন। হিমালয় কি, কত মহৎ, সে বিষয়ে আমাদের গ্রামের
মানুষ, পারম্পরিক মানুষ সচেতন ছিলেন। ছোটবেলায় জয়াদি পাহাড়ে থাকতেন। একটি ঢিল
ছোঁড়ার উদাহরণ দিলেন, বললেন, কিভাবে সেই অঞ্চলের মানুষ তাকে বকেছেন এই ঢিল ছোঁড়ার জন্য কেননা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে। তাঁরা
প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা কাকে বলে জানতেন, তার গুরুত্ব বুঝতেন, তাই সেগুলো ভাঙার চেষ্টা
করেননি। তাঁরা নিজেদের সঙ্গে প্রকৃতিকে নিয়ে চলতেন। মানুষ যখন বসতি তৈরি করে তখন
প্রাকৃতিক নিয়মের বিরুদ্ধে যায়। প্রকৃতিকে পাল্টানোর চেষ্টা করে। আমাদের গ্রামের
মানুষেরা প্রাকৃতিক নিয়ম মেনেই প্রকৃতিকে পাল্টানোর চেষ্টা করেছেন। ঝুম চাষের কথা
বললেন। কি ভাবে প্রকৃতিকে রক্ষা করে স্থানীয়রা ঝুম চাষ করছেন তাও জানান। বললেন
আমাদের ধারণা আছে ঝুমের জন্য মাটি আলগা হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না কেন না
তাঁরা জানেন কি ভাবে তা আটকাতে হয়। ধাপগুলো পাহাড়ের দিকে একটু ঢাল করে কাটা হয়
যাতে পাহাড়ের গা বেয়ে নামা জল সোজা না গড়িয়ে পড়ে। আর ধাপের শেষের দিকে এক চিলতে ঘাসএর
আস্তরন তৈরি করে রেখে দেওয়া হয়।
আমাদের গ্রামীণেরা যে মাটির প্রকৃতি বুঝে
চাষ করতেন, জলের প্রবাহ বুঝে সেচ দিতেন, তার একটি উদাহরণ দলেন বীরভূমের। মাটি লাল।
কাঁকুরে। জমি উঁচুনিচু। প্রকৃতির দেওয়া এই ভুপ্রকৃতিকে তারা মনে করতেন প্রকৃতির
দান। তাকে সঙ্গে নিয়েই জীবন চালাতে হবে। এই মাটি ২৪ পরগনার আঠাল, ছোট দানার মাটি
নয়। কিন্তু গত ৪০-৫০ বছরে বীরভূমের মাটিকে সরকারি উদ্যমে বহু অর্থ বিনিয়োগ করে
চৌরস, অর্থ, সমান করা হয়েছে। কাঁদরের কথা বললেন। বীরভূমের ছোট বড় অসংখ্য নদীর
শুরুই এই কাঁদর দিয়ে। সারা বাঙলায় বর্ষাকে খুব ভাল ভাবে নেওয়া হত। কেননা বর্ষা পলি
ফেলত, সেই পলি দিয়ে চাষ হত। যখন থেকে উচ্চফলনশীল ধান চাষ শুরু হল, সব কিছু চাষ
ফেলে বলা হল শুধুই ধান চাষ করতে, তখনই প্রকৃতিকে ধংস করার কাজ শুরু হল। বর্ধমানের
মাটি যেমন, তেমন বীরভূমের মাটি নয় – কেন ভেবে দেখেছেন কেউ? ৭৭এর বীরভূমের বন্যার
ভয়াবহতার কথা বললেন। যেখানে মানুষ বন্যা জীবনে দেখেনি সেখানে বন্যা হল। জমি ৮/১০
ফুট বালির তলায় তলিয়ে গেল। বন্যা সেচ দিত আর উর্বরতা তৈরি করত। কিন্তু বন্যাকে আমরা
দুঃখ হিসেবে দেখলাম। আমার কি আছে তা দিয়েইতো আমরা সংসার চালাই। অথচ আজ আমাদের কি
আছে তা বিচার না করে আমরা তাকাই পশ্চিমের দিকে। এটি শুধু বাংলা নয়, সারা ভারতের
ছবি। আমাদের যে উৎপাদন পদ্ধতি ছিল, বিতরন পদ্ধটি ছিল তার প্রায় সব হারিয়ে ফেলেছি।
এই যে কৃষির বিশৃঙ্খলার কথা বললাম, তার
সঙ্গে গাড়োয়ালের বিপর্যয়কে এক করেই দেখতে হবে। আমরা প্রকৃতিকে জয় করতে চাইছি।
এভারেস্টে ওঠা বাচেন্দ্রি পাল বলেছিলেন এভারেস্টকে জয় করা যায় না। সে কাউকে কাউকে
পাশে আসতে দেয়। এই নদী জোড়া প্রকল্পই ধরি। আসানসোলের এক চাষিকে বলেছিলাম। সে দারুন
এক উত্তর দিয়েছিল, নদী যদি জুড়তেই হত তাহলে আগে থেকেই জোড়া থাকত। এত বড় বড় গর্ত
কাটতে হত না।
নদী মানেই শুধু জল নয়, আরও অনেক কিছু। ঢাল,
উপকূল নানান সবের সমাহার নিয়েই নদী। সেই নদীর নানান বিষয় নিয়েই মানুষ বাঁচতেন। আজ
যত সাধারণ জীবনের থেকে দূরে সরে যাচ্ছি তত প্রকৃতিকে ধংস করছি। কৃষি মানেই শুধু
চাষ নয়, বিশাল এক সংস্কৃতির অংশ। চাষ মানেই এখন ধান চাষ হয়ে গিয়েছে। জানুর বই থেকে
জঙ্গলের উদাহরণ দিলেন। বললেন মা অনেক সময় ছেড়ে চলে যান, কিন্তু জঙ্গল কোনোদিন ছেড়ে
যায় না। আমলাশোলের কথা বললেন। রেল পথ তৈরির জন্য নয়ানজুলি গঠনের কথা বললেন। ১৪
শাক, নবপত্রিকার কথা বললেন। যত বেশি ধান তত বেশি টাকা বলে দেওয়া হল। নদী নালা বুজে
নদীকে বেঁধে, নদীর ওপর বাঁধ বেঁধে নদী বিজ্ঞান বিরোধী কাজ হচ্ছে।
এর পর জয়াদি এমন কিছু কথা বলেন, যা ভীষণ হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করছিল। কলম বন্ধ করে শুধুই শুনছিলাম যে কত সহজে, কত সাধারণ অথচ কাব্যিক ঢঙে এটি জটিল অথচ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নানান ঘটনা, তথ্যের কথা অনর্গল বলে যেতে পারেন। ফলে অনেক গুরুত্বপুর্ন কথা, তথ্য আমারই অক্ষমতায় আর তুলেদিতে পারা গেল না।
এর পর জয়াদি এমন কিছু কথা বলেন, যা ভীষণ হৃদয়ে গিয়ে আঘাত করছিল। কলম বন্ধ করে শুধুই শুনছিলাম যে কত সহজে, কত সাধারণ অথচ কাব্যিক ঢঙে এটি জটিল অথচ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নানান ঘটনা, তথ্যের কথা অনর্গল বলে যেতে পারেন। ফলে অনেক গুরুত্বপুর্ন কথা, তথ্য আমারই অক্ষমতায় আর তুলেদিতে পারা গেল না।
No comments:
Post a Comment