দর্শণটির তাত্বিকদের বক্তব্য
ইওরোপের শিল্প বিপ্লবের এবং ব্যাপক নিখুঁত প্রযুক্তির বিকাশ এবং তত্কান্ডে ইওরোপের
প্রযুক্তি আর অর্থনৈতিক বিকাশের পিঠেপিঠি যে কান্ডটি ঘটেছে, সেটি হল তথাকথিত
পিছিয়ে পড়া বাঙলা, ভারত অথবা এশিয়ার নানান দেশের প্রাগৈতিহাসিক উতপাদন ব্যবস্থা
স্বাভাবিক পদ্ধতিতেই মৃত্যুবরণ করেছে। এর জন্য ইংরেজ সাম্রাজ্যের ওপর দোষ
চাপানো এশিয়দের বরাবরের ঘৃণিত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত উদ্যম। এই তত্ব বহুপ্রাচীণ। আজকের
ইওরোপে এই মিথ-মিথ্যাভিত্তিক তত্বের সফলতম প্রবক্তা পি জে মার্শাল – এবং তাঁর অনুগামী বহু ভারতীয়, বলাভাল বহু বাঙালি মণীষা। তিনি এবং
তাঁর সঙ্গীসাথীরা বলার চেষ্টা করছেন, শিল্পবিপ্লবজাত পশ্চিমি নতুন সমাজের বিস্তৃত
এবং উন্নততর উত্পাদন ব্যবস্থা সমগ্র ইওরোপে, এশিয় দ্রব্যের চাহিদার অন্ত ঘটায়। ফলে
চাহিদার অভাবে ক্রমশঃ ভারতীয় তথা এশিয় উত্পাদনব্যবস্থা প্রায় মৃত্যুমুখে ঢলে পড়তে
থাকে।
ভুক্তভোগী ভারতীয়রা এর উত্তরে
বলতে পারেন ভারত তথা বাঙলা লুঠের সম্পদে আর জ্ঞাণে ইওরোপে যে দৈত্যসম উতপাদন
পরিকাঠামো আর সেই উত্পাদনব্যবস্থাজাত পণ্যের বাজার তৈরি হয়েছে, তার প্রধাণ অনুঘটক
ছিল গায়ের জোরে বাঙলা তথা ভারতীয় জ্ঞাণচর্চা, উত্পাদন পরিকাঠামো আর বাণিজ্য
ব্যবস্থাকে ধংস করা। নইলে ভারতজুড়ে ইওরোপিয় জ্ঞাণ, প্রযুক্তি আর উত্পাদিত
দ্রব্যের বাজার গড়ে উঠতে হয়ত পারত না। চিরাচরিত এশিয় জ্ঞাণ-প্রযুক্তি
চুরি, জাগতিক সম্পদ লুন্ঠণ এবং সামাজিক উত্পাদন এবং ব্যবসার পরিকাঠামো ভেঙে যে
বিশ্বধংসজনক শিল্পবিপ্লব পরিকাঠামো প্রথমে ইংলন্ডে পরে ইওরোপের নানান দেশে গড়ে
উঠেছিল তাকেও শহুরে সামাজের, শিক্ষার এবং জ্ঞাণচর্চাগত বৈধতা দেওয়া যায় না। বাঙলা
এবং পরে ভারতের তৃণমূলস্তরের উত্পাদন এবং বাণিজ্য পরিকাঠামো ভাঙতে সুসভ্য ইংরেজরা
সেনা পর্যন্ত নামিয়ে, গ্রামীণ স্বাধীণতা সংগ্রাম দমন করে, অবাধ বাণিজ্যের
মূলসূত্রগুলি প্রয়োগ করার কাজ করার কাজ করে গিয়েছে নিরন্তর।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, ক্লাইভ, হেস্টিংসের লুঠেরা সময়
পেরিয়ে এসেও, ১৮০০ সাল পর্যন্ত ভারত-চিনের শিল্প উত্পাদন মোট বিশ্ব শিল্প
উত্পাদনের ৭০ শতাংশ। নাটকীয়ভাবে ১৮৩০এর পর
এই অংশিদারি কমতে কমতে আজ স্বাধীণতার পর মাত্র ১ শতাংশে উপনীত হয়েছে। যতদিন অকেন্দ্রিভূত উত্পাদন ব্যবস্থা এবং বিতরণ
ব্যবস্থা টিকে ছিল, ততদিন কিন্তু বিশ্বে শিল্প উত্পাদনে ভারত নেতৃত্ব দিয়েছে। যেদিন থেকে সে কেন্দ্রিভূত বড় বড় দৈত্যসম উত্পাদন
ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকেছে, সেদিন থেকেই শিল্প উত্পাদনের ক্ষেত্রে ভারতের পতনের শুরু। বিশ্বায়িত রাজনীতির প্রেক্ষিতে বিদেশি ইওরোপিয়দের
বলপ্রয়োগে ধংসকরে ফেলা কেন্দ্রবিহীন ভারতীয় সনাতন সমাজ, সাধারণ মানুষের অর্থনীতি,
ব্যবসা নিয়ে বোধহয় বিদ্যালয়, পঠনপাঠনস্তরে খুব বেশি আলোচনা হয় না। এই অকেন্দ্রিক অর্থনীতি একদা কয়েক হাজার বছর ধরে
তথাকথিত আর্থিক ঔজ্জ্বল্য প্রদর্শণ না করেও বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের স্থানকে এক
অনন্যমাত্রায় তুলে ধরতে সাহায্য করে ছিল, দেশিয় অর্থনীতিকে নিজেরমতকরে গড়ে তোলার
কাজ করেছিল অবিরত। সারা বিশ্বে বাঙলা
তথা ভারতের উত্পাদন আর ব্যবসার অকেন্দ্রিকৃত অর্থনীতিই এশিয় বাজারকে সারা বিশ্বের
গন্তব্যস্থলরূপে গড়ে তুলেছিল।
ভারত-চিন-পারস্যকেন্দ্রিক এশিয় অর্থনীতি বরাবরই ইওরোপের লুঠেরা দর্শণভিত্তিক
কেন্দ্রিভূত অর্থনীতির বিপরীত পথে হেঁটে নিজেরমতকরে এক বিকেন্দ্রভূত অর্থনীতির
রূপরেখা তৈরি করেছে হাজার হাজার বছর জুড়ে।
বড় বড় প্রাকার বিশিষ্ট সমাজ বিচ্ছিন্ন দৈত্যসম কারখানাগুলোর বিপরীতে কোনও রূপ
কেন্দ্রাতিগ শক্তিব্যাতিরেকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য ছোটছোট উতপাদন ব্যবস্থা,
আর সেই উত্পাদন সারা দেশে, অঞ্চলে, বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে নানান ধরণের তৃণমূলস্তরের
ব্যবসায়ীর অংশগ্রহণের অর্থনীতি, একদা ভারত-চিন-পারস্যকে বিশ্বঅর্থনীতির
অক্ষদন্ডরূপে দাঁড়িয়ে ছিল সবলেই। সমাজের দর্শণ মেনে এই
উত্পাদকদের সামাজিক কর্মকান্ডে, ব্যবসায়ীরা সমাজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
অংশিদাররূপে সমাজে স্বীকৃতও হয়েছে। শুধু শহুরে সমাজ এদের
অবদান স্বীকার করতে বরাবরই কুণ্ঠা প্রকাশ করেছে। আজও সেই অভিমুখের আজও বদল ঘটেছে কী না সন্দেহ।
No comments:
Post a Comment