দস্তা ধাতুবিদ্যা বিকাশে ভারতের অবদান
আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র মনে করতেন, দস্তা প্রক্রিয়াকরণ
পদ্ধতি ভারতীয়রা চিনাদের থেকে শিখেছে। তিনি বলেন বোধহয় ভারত-চিন বাণিজ্য মার্ফত
চিন থেকে উত্তর ভারতে দস্তা প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তির আমদানি হয়। অরুন কুমার
বিশ্বাস বলছেন, ব্যাপারটি উলটোই। ভারত যে দস্তা নিষ্কাশন পদ্ধতিটি বিকাশ করে, সেই
পদ্ধতিটি বৌদ্ধরা চিনে বহন করে নিয়ে যায় যতদূর সম্ভব প্রথম খ্রিস্টপুর্বাব্দে, হয়ত
তার আরও অনেক পরে। যে আর পার্টিংটন আ শর্ট হিস্ট্রি অব কেমিস্ট্রিতে চিনে ব্রাস
এবং দস্তার তৈরির যে বর্ননা দিয়েছেন তার আসলে ভারতীয় প্রযুক্তির সরাসরি নকল।
রাজস্থানের ঝাওয়ার খনির কাঠগুলির কার্বন পরীক্ষা করে
দেখাগিয়েছে দ্বিতীয় খ্রিস্টপুর্বাব্দেও সেই খনিথেকে দস্তা নিষ্কাশন, এবং সেখানেই
তা প্রক্রিয়াকরণ করা হত। তক্ষশীলায় যে দস্তার চুড়ি পাওয়া গিয়েছে ২ থেকে পঞ্চম
খ্রিস্টপুর্বাব্দের, সেটিতে ১৩ থেকে ২০% দস্তার মিশেল রয়েছে।
প্রফুল্ল চন্দ্র অবশ্য প্রথম খ্রিস্টাব্দের অযোধ্যার
ধনদেব এবং আর্য্যবর্মার দস্তার পয়সা, দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের মাণিক্যালয়ের
বুদ্ধস্তুপের দস্তার মাণিক্যআধার, ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দের কাংড়াকোটের কাছের ফতেপুরের
দস্তার বুদ্ধমুর্তি, সপ্তম খ্রিস্টাব্দে নালন্দার দস্তার বিহারের(অসম্পুর্ণ) বর্ননা
করছেন। ইতিহাস, প্রত্নতত্ব প্রমাণ, ভারত প্রাচীন কাল থেকেই কপার, লোহা এবং দস্তা
ধাতুবিদ্যার গৌরবময় বিকাশ ঘটিয়েছিল এবং এই প্রযুক্তি সে সারা বিশ্বকে সে দান করেছে
চরম ঔদার্য্যে।
এই তথ্য প্রমাণের তিনটি উপায় ১) যা পাওয়া গিয়েছে তাঁর
তারিখ নির্নয় করা, ২) সময়ের সাহিত্যের পানে নজর দেওয়া, ৩) প্রত্নতত্বের সাহায্য
নেওয়া যার মাধ্যমে খাদানের প্রমাণ, প্রযুক্তির প্রমাণ, নানান ধরণের বর্জ্যের
প্রমাণ পাওয়া যাবে।
সাহিত্যিক প্রমাণ
১৫০০ সালের দীর্ঘ ইতিহাস দাঁড়িয়ে রয়েছে, কৌটিল্যের
অর্থশাস্ত্র থেকে ররস এবং তারও পরের সময় পর্যন্ত, ধাতু বিদ্যা চর্চার ইতিহাসের
সাহিত্যিক প্রতক্ষ্য এবং পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যাবে। কৌটিল্যে দস্তার নাম আরাকুট,
চরকে ঋতি এবং ররসতে ঋতিকা এবং আর এক প্রকারের নাম কাকাতুন্ডি।
সোনালি ব্রাসের হঠাত উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গেই দস্তা তৈরির
পদ্ধতিটির বিকাশ ঘটল। নাগার্জুণ রসরত্নাকর লেখার আগেই এই তথ্য জানতেন, হোয়াট
ওয়ান্ডার ইস ইট রসক(দস্তার খনিজ চুর্ণ)... রোস্টেড থ্রাইস উইথ কপার, কনভার্ট থে
ল্যাটার ইন্টু গোল্ড(রসক ... করোতি সুল্ভাম্ ত্রিপুটেনা কাঞ্চনম)। ঠিক এই সময়ে
ধাতুর পরমানুর অদলবদল ঘটিয়ে যে কোনও ধাতুকে সোনা আর পারদে রূপান্তরিত করে ফেলার
উদ্যমের কিমিয়া বিদ্যার গবেষণার শুরু। পরে রসরত্নাকরে বলা হচ্ছে রসকর পাতনের সময়,
কপার যুক্ত না করা গেলে টিনের মত একটি ধাতু তৈরি করতে পারে। রসার্নব টিন রকমের
খনিজ দস্তার খোঁজ পাচ্ছে এবং তার আগে লেখা রসরত্নাকরের অভিজ্ঞতা নতুন করে বর্ননা
করছে। যশোধর তাঁর রসপ্রকাশশুদ্ধকরএ দুই রকমের রসকের অর্থাৎ খনিজ দস্তার কথা বলছেন।
এবারে আমরা ররসএর দস্তার বর্ননায় প্রবেশ করি। খনিজ দস্তা
বা খর্পর বা রসক দুই ধরণের ১) ডালার মত দুরদুর বা প্লেটএর মত ২) করভেল্লক বা
প্লেটএর মত নয়। প্রথমটি ধাতু নিষ্কাশনের জন্য ভাল, অর্থাৎ সত্বপাতন, এবং দ্বিতিয়টি
রোগসারাবার জন্য আদর্শ।
এখন বলে যাবে না যে, ওপরে দু ধরণের বর্নিত খনিজ় দস্তা
কারবনেট অথবা সালফেট পরিবারের। ররস বলছে দস্তা গলানোর আগে, ধাতু চুর্ণকে কাঞ্জিকা
বা কটুতুম্বির(লেবুর রস) এসিড বা মুত্র যুক্ত করে তাতিয়ে নিতে হবে যাতে তার ক্যালসিয়াম
এবং ম্যাগনেসিয়াম কারবনেট দ্রবীভুত হয়ে যায়।
স্মেলটিঙের সময় বিভিন্ন কার্বনযুক্ত গাছড়া এবং বোরাক্স
ব্যবহৃত হয় ফ্লাক্স দ্রবন হিসেবে। এই কাজটি বেগুনের মত দেখতে একটি উচ্চচাপযুক্ত
ক্রুসিবল যার নাম ব্রন্তক মুসায় করা হয়। এটির সঙ্গে ১২ আঙ্গুলের একটি উলটো নল,
উলটো ধুতুরার মত দেখতে যুক্ত থাকে।
স্মেল্টিঙ্গের বহুবিধ প্রক্রিয়া ব্যাখ্যাত হয়েছে ররসয়।
প্রথম প্রক্রিয়ায় শুকনো, একের ওপরে অন্যটি রেখে ধাতু উচ্চচাপের চুল্লিতে তাপিত হয়।
যখনই নীল আগুন সাদা হয়ে যায় সেই মুহূর্তে রিডাকসন পদ্ধতিটি শেষ হয়ে যায়। তখন
ক্রুসিবলটি একটি বড় চিমটায় ধরে বাঙ্কিয়ে তপ্ত গলিত ধাতুটি বের করে নিতে হয়। এবং
আরও দুটি পদ্ধতি এখানে আলচিত হয়েছে।
ররসর সংকলক প্রাথমিকভাবে খুব বিশদে আলোচনা করছিলেন
দস্তার সঙ্গে আরসেনিক সালফাইড জুড়লে কি ধরনে ওষুধ তৈরি করা যায়। কিন্তু তিনি
ক্রমশঃ এই প্রসঙ্গ ছেড়ে বিশদে যেটি আলোচনা করা শুরু করেন সেটি হল দস্তা তৈরির
প্রক্রিয়া। এবং সেই কাজটি তিনি করেছিলেন বলেই প্রায় ৯০০ বছর পরেও ধাতুবিদ্যার
গবেষকেরা পুরনো ভারতের এই গৌরবের জয় গাথাটি ঘোষণা করতে পারছেন সারা বিশ্বের সামনে,
নানান তৈরি করা তথ্যের জাল সরিয়ে দিয়ে। শুধু দস্তাই নয় তার সঙ্গে নানান ধরণের
মৌলিক ও সঙ্কর ধাতু তৈরির বিশদ বর্ননা দিয়েছেন।
ব্রাস(পিত্তল) তৈরি হয় জিঙ্ক আর কপারের সঙ্করে বা কপারের
উপস্থিতিতে জিঙ্ক খনিজের সরাসরি রিডাক্সনের মাধ্যমে। খুব ভাল ব্রাস যার নাম ঋতিক
ধর্ম হল নরম বা সফট, মসৃন, হলুদ এবং নমনীয় বা ম্যালিয়েব্ল(পিতাভ তাডনাক্ষম)। গরম
লেবুর জলে(কাঞ্জিক) ডুবিয়ে রাখলে ঋতিক লাল বর্ণ ধারন করে কিন্তু তার পরে
কাকুতুন্ডি বা কালো আকারের নিম্ন মানের পিতলে পরিণত হয়।
সাহিত্যিক সূত্র শেষে বলতেপারি, নাগার্জুন দস্তা তৈরি
পদ্ধতি এবং কিমিয়া বিদ্যার উদ্গাতা।
আলবিরুনি নাগার্জুনকে নবম বা দশমশতে এনে ফেলেছেন। এবং তা কোনও ভাবেই ইতিহাস
সম্মত নয়। হিউএনসাঙ্গ স্পষ্টভাবে নাগার্জুনের কিমিয়াবিদ্যার পরিচয় দিচ্ছেন, এবং সে
সময় অনেক আগের। রেনঁ এনং ফিল্লিওযাট প্রমাণ করেছেন নাগার্জুন প্রথম শতের শেষের
দিকে বিরাজ ছিলেন।
ররস স্পষ্টভাবে বলছে, নাগার্জুন মনে করতেন পারদ(রস) এবং
দস্তা(রসক) দুটিই খুব প্রভাবশালী ধাতু ঔষধ। এ দুটি দেহের তন্তুগুলিকে শক্ত করে। এর আগে আমরা বলেছি
নাগার্জুন বলছেন ব্রাসের স্বর্নাভার বর্ণনা। দস্তার নাম দিচ্ছেন যসদায়ক, যসদা বা
যসতে(বাঙলা এবং হিন্দিতে - দস্তা) অর্থাৎ যা যশ দান করে।
তৃতীয় উদাহরনটি হল প্রত্নতাত্বিক। প্রবন্ধটি লেখার প্রায়
এক শতক পুর্বে লেড-জিঙ্ক ঝাওয়ার খনির সমীক্ষায় পুরনো বর্জ্যের নিদর্শন উল্লিখিত
হয়েছে। সাম্প্রতিক উৎখননে প্রমানিত হয়েছে এটি দ্বিতীয় খ্রিস্ট পুর্বাব্দের এবং
দুটি চুল্লি পাওয়া গিয়েছে, যেটিতে ৩৬টি পাতন যন্ত্র(রিটর্টস) এখনও চার্জ রয়েছে।
চুল্লিটির দুটি অংশ। নিচেরটি ওপরের মূল অংশের সঙ্গে জুড়ে আছে ছোট ছোট ছিদ্রওয়ালা
ইটের গাঁথনির মাধমে, যেন একটি মাথা কাটা পিরামিড। ওপরের অংসে অনেকগুলো বেগুনের
চেহারার পাতন যন্ত্র, ররস বর্নিত ভ্রন্তক মুসায় এখনও কিছু ধাতু সাজানো রয়েছে যেটি
শেষ অবস্থায় ৪-৫ ঘণ্টা শরে ১২০০ সেন্টিগ্রেডে তাপ পেয়েছে। একটি মাটির নল পাতন
যন্ত্রের মুখে লাগানো। এটির কাজ ছিল চুল্লি থেকে বেরনো জিঙ্কের বাষ্প সংগ্রহ করে
একটি ঠাণ্ডা ঘরের মেঝেয় বা ঠাণ্ডা জলে জিঙ্ক সংগৃহীত করা। যেমন ররসয় বর্ননা করা
রয়েছে ঠিক তেমনি করেই যেন গোটা নাট্যশালাটি সাজানো।
পাতন যন্ত্রগুলো পরস্পরের থেকে কিছু দূরে দূরে অবস্থিত,
দূর থকে দেখলে যেন মৌচাকের মত মনে হয়। চিনা পদ্ধতিটিও প্রায় একই ধরণের কিছু খুব
ছোট ছোটভাবে আলাদা এবঅং সেটি প্রযুক্তি সঠিকভাবে না জানার কারনে ঘটেছে।
বিশাল পরিমাণে পাতন দ্রব্য, যা আসলে পরিশ্রুত জিঙ্কএর
অধঃপাতিত অংশ এবং আলাদা চকচকে কাচের মত বর্জ্য, যা লেড পরিশোধন করার পরে অধঃপাতিত
অংশ, ঝাওয়ার খনিতে পড়ে রয়েছে জা একনো অর্থনৈতিকভাবে তুলে এনে বিক্রি করা যায়। লেখক
এবং তার সাথীরা একটি এক্সরে, ইলেক্ট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র এবং ডিটিএ সমীক্ষা যন্ত্র
নিয়ে গিয়েছিলেন যাতে নানান দ্রব্য বিশ্লেষণ করা যায়। বর্জ্যতে রয়েছে ০.১-০.৩%
গন্ধক এবং এর সিলিসেয়াস-কারবনেট যৌগ প্রমাণ করে যে কোয়ার্টজ এবং ডলোমাইট সমৃদ্ধ
সালফাইড খনিজ পাশের খনি থেকে আনা হয়েছিল জিঙ্ক তৈরি করার জন্য সুদূর দ্বিতীয়
খ্রিস্ট পুর্বাব্দের কোনও এক সময়ে।
No comments:
Post a Comment