ধরিতে গেলে এই শেঠ ও
বসাকগণ কলিকাতার ‘জঙ্গল-কাটা’ বাসিন্দা। তাঁহারা যদি ষোড়শ শতাব্দীতে সপ্তগ্রাম
হইতে – সুতালুটীতে আসিয়া বাস না করিতেন, তাহা হইলে এই কলিকাতাকে আজ আমরা
প্রাসাদময়ী নগরী রূপে দেখতে পাইতাম না।
প্রাচীন কলিকাতায় যে
হাট পত্তন হইয়াছিল, তাহা চণ্ডীকাব্যের বর্ণনা হইতে জানা যায় –
ধালিপাড়া, মহাস্থান, কলিকাতা, কুচিনান,
দুই কূলে বসাইয়া বাট
পাষাণে রচিত ঘাট, দুকূলে জাত্রির নাট
কিঙ্করে বসায় নানা হাট।।
প্রাচীন কলিকাতায়
বসুকেরাই প্রথমে একটী হাট স্থাপনা করেন। চণ্ডীকাব্যের বর্ণনা হইতে দেখা যায়,
কলিকাতার তখনকার হাটসমূহ হইতে হয়ত ভবিষ্যতে ‘সুতালূটী হাটখোলা’ বা ‘সুতালূটী
হাটতলা’ দাঁড়াইয়াছে। তখনকার হাট সমূহ পাকা-পোক্তা ধরণের ছিল না। হয়ত উন্মুক্ত
স্থানেই অনেক হাট বসিত। এই জন্য হয়ত ‘খলা-হাট’ এই আখ্যা হইতে ক্রমশঃ তাহা
‘হাটখোলায়’ দাঁড়াইয়াছে।
বেতাকীর খালের
দূর্দ্দশার সহিত, বেতোড়ের হাট ক্রমশঃ শ্রীহীন হইতে থাকে। পর্টুগীজ বণিকেরাও তথায়
যাতায়াত বন্ধ করিয়া দেন। বেতড়ার হাটের ধ্বংস হইলে কলিকাতার হাটের প্রাণ প্রতিষ্ঠা
করেন – সে সময়ে সুতালূটীর হাট বেশ জোরে চলিতেছিল। কারণ জব চারণক নিজেই লিখিয়াছেন –
‘চারিদল শেঠ ও বসাকেরা সপ্তগ্রামের অধঃপতনের সুচনা দেখিয়া গোবিন্দপুরে বসবাস করেন।
তাঁহারা প্রথমে বেতড়ের বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। বেতোড়ের অধঃপতনের পর সুতালূটীর হাট
প্রতিষ্ঠিত হয়(The foreign market attracted native and merchant to
the spot and in particular from families of Bysacks and one of Sets leaving the
then rapidly declining city od Satgong came and founded the Settlement of Gobindpur
and established Suttnutai market on the north side og Calcutta (Wilson, 128))।’
জব চার্ণক কর্ত্তৃক
কলিকাতা প্রতিষ্ঠার প্রায় সাতাশ বৎসর পরে, এই প্রাচীন কলিকাতার যে সামান্য উন্নতি
হইয়াছিল, তাহা সমসাময়িক হ্যামিল্টন সাহেবের বর্ণনা হইতে জানিতে পারা যায়।
বসুক নামক গ্রন্থ
রচয়িতা বলেন, ‘সম্ভবতঃ খৃষ্টের ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে বসাকেরা কলিকাতায় আসিয়া
প্রথম বসবাস করেন। সসাকেরা পর্টুগীজ ও অংরাজ উভয় জাতীয় বণিকদের সহিত ব্যবসায়সূত্রে
লিপ্ত ছিলেন। বেতোড়ের হাটের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে, এপারে সুতালূটীর হাট জাঁকিয়া
উঠে। বসুকেরা ধরিতে গেলে কলিকাতার ‘জঙ্গল কাটানো’ অধিবাসী। ১৭১৭ খৃঃঅব্দের
মধ্যবর্ত্তী সময়ে – বংশবৃদ্ধির সহিত তাঁহারা প্রাচীন কলিকাতার বিস্তারিত হইয়া
পড়েন।’ এ সম্বন্ধে সমসাময়িক হ্যামিল্টন সাহেব যাহা বলিয়াছেন, তাঁহার মর্ম্মারথ এই,
- ‘১৭১৭ খৃঃঅব্দে কলিকাতার অবস্থা অন্যরূপ ছিল। বর্ত্তমান নগরী সেই সময়ে নদীয়া
জেলার অন্তঃর্ভুক্ত কয়েকখানি ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল। দশ বারখানি ঘর লইয়া, এক একটী
ক্ষুদ্র গ্রাম। গ্রামের অধিবাসীরা অনেকেই কৃষকশ্রেণীভুক্ত। চাম্পাল ঘাটের(চাঁদপাল)
দক্ষিণে এক বনভুমি। ক্ক্রমে এই বন পরিস্কৃত হয়। খিদিরপুর ও এই বনভুমির মধ্যে
দুইখানি গ্রাম ছিল। এই সময়ে শেঠ ও বসাকেরা এখানকার প্রধান ব্যবসায়ী। তাঁহাদের
যত্নেই এসব গ্রামে লোকের বসবাস হয় ও ইহা রকটী ক্ষুদ্র নগরীতে পরিণত হয়। বর্ত্তমান
ফোর্ট উইলিয়াম(গড়ের মাঠের পার্শ্ববর্ত্তী স্থান) ও এসপ্ল্যানেডের(ধর্ম্মতলার
নিকটবর্ত্তী স্থান) অধিকৃত ভূভাগেই উল্লিখিত বনভুমি ও দুইখানি ক্ষুদ্র গ্রাম ছিল।
১৭১৮খৃীঃঅব্দে চৌরঙ্গীর জঙ্গলের মধ্যে দুই একখানা গ্রামের অস্তিত্ব দেখা যায়। এই
সকল ক্ষুদ্র গ্রামের চারিদিকে নালা নর্দ্দমা ও খাল। ধরিতে গেলে, এই সময় চিৎপুর
হইতেই কলিকাতার একদিক ব্যাপিয়া খাল খনন করানো হয়। ইহা ‘মারহাট্টা-ডিচ’ বা
‘বর্গীর-খাত’ বলিয়া বিখ্যাত। সেরাজউদ্দৌলা যে সময়ে কলিকাতা আক্রমণ করেন, সেই সময়
এসপ্ল্যানেড, চৌরঙ্গী ও ফোর্ট উইলিয়াম বলিয়া পরিচিত, ১৭৫৬খৃীঃ অব্দেও তাহা জঙ্গলময়
ছিল। এই জঙ্গল সমূহের মধ্যে ক্ষুদ্রগ্রাম ও মধ্যে মধ্যে গোচারণ ভূমি।’(২৯৪ পৃ নাই)
...ইংরাজদিগের মত
ওলান্দাজ, ফরাসী ও দিনেমারেরা সেথ ও বসাকদিগের সহিত বাণিজ্যকাজে লিপ্ত ছিলেন।
ওলান্দাজ ও ডচদিগের আগমনে পর্টুগীজদের বাণিজ্য অনেকটা কম জোর জইয়া পড়ে।
ওলান্দাজেরা খিদিরপুর হইতে শাঁকরালের খাল পর্য্যন্ত, ভাগিরথীর অংশকে গভীর করিয়া
দেন। ঐ জন্য ঐ অংশকে ‘কাটি-গঙ্গা’ বলে।
No comments:
Post a Comment