হিউয়েন্সিয়ঙের আগমনের পূর্ব্বে যখন ভারতবর্ষ উজ্জয়নাপতি
বিক্রমাদিত্যের প্রতাপ ও বিদ্যোৎসাহীতার আলোকে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল, তখন সে
আলোকে এই সুদূর বঙ্গভূমিও দৃষ্টির অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল। সেইজন্য কালিদাস ও বরাহমিহিরের
গ্রন্থে বঙ্গের উল্লেখ দৃষ্ট হইয়া থাকে। কালিদাস বঙ্গের অধিবাসীগণকে নৌযুদ্ধকুশল
বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বরাহমিহিরও বঙ্গ ও উপবঙ্গের উল্লেখ করিয়াছেন। প্রাচীন গ্রন্থাদিতে
ও প্রাচীন লোকের নিকট আমাদের মাতৃভূমি বঙ্গনামেই অভিহিত হইতেন। কিন্তু ক্রমে তিনি
বাঙ্গালা নাম ধারণ করিয়া সাধারনে পরিচিত হইয়া উঠেন। খৃষ্টীয় নবম শতাব্দী হইতে
একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে আমরা প্রথম বাঙ্গলা নামের উল্লেখ দেখিতে পাই। দাক্ষিণাত্যের
রাজেন্দ্র চোল দেবের তিরুমলয়নামক স্থানের শিলালিপিতে প্রথমে এই বাঙ্গালাদেশের
উল্লেখ দেখা যায়। রাজেন্দ্র চোল দেব তথাকার গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করিয়াছিলেন
বলিয়া তিরুমলয়ে আপনার গৌরব খোদিত করিয়াছেন। তাঁহার পর আমাদের মাতৃভূমি বঙ্গনাম পরিত্যাগ
করিয়া বাঙ্গলানাম ধারন করিয়াছেন। সেই ফুলফলসুশোভিতা, শস্যশ্যামলামাতাকে আমরা সোনার
বাঙ্গলা বলিয়া থাকি।
ক্রমে মুসলমান গৌরব ও প্রতিভা সুদূর ইউরোপখণ্ড হইতে চীনদেশ
পর্য্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়, সেই সময় বঙ্গভূমি মুসলমান পরিব্রাজকগণের নিকট অপরিজ্ঞাত
ছিল না। মুসলমানগণকর্ত্তৃক ভারতবিজয় আরব্ধ হইলে বঙ্গদেশও তাঁহাদের দৃষ্টিপথে পতিত
হয়। খৃষ্টীয় অষ্টম শতব্দীতে সুলেমান আমাদের সোনার বাঙ্গলায় আগমন করিয়াছিলেন। তিনি
ইহাকে সমৃদ্ধশালী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, এবং ইহার বাণিজ্যগৌরবের বিষয়ও উল্লেখ
করিতে বিস্মৃত হন নাই। ইবনবাটুটানামক একজন মুসলমান্ পরিব্রাজক অনেক পরে এ দেশে
আগমন করেন, তিনি ইহাকে অত্যন্ত শস্যসুলভ বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন। বৈদেশিকগণের বিবরণ
যতই আলোচনা করা যায়, ততই আমাদের মাতৃভূমিকে সোনার বাঙ্গলা বলিয়া প্রতীয়মান হয়।
পুরাকাল হইতে স্বর্ণপ্রসবিনী বঙ্গভূমি বৈদেশিকগণের চক্ষে স্বর্ণকিরণ প্রতিফলিত
করিয়া আসিতেছেন। ফলেফুলে সুশোভিনী মা আমাদের কৃষিবাণিজ্যে সমৃধিশালী হইয়া জগতের
নিকট সগৌরবে আদৃত হইতেন। তাঁহার সন্তানগণ জ্যোৎস্নাচুম্বিত-সৈকতশালিনদীমালিনী
শস্যশ্যামলা মাতৃভূমির সেবায় আপনাদের জীবন উৎসর্গ করিত। কৃষি বাণিজ্যেও তাঁহাকে গৌরবশালিনী
করিয়া তুলিয়াছিল। মা তাহাদিগকে পবিত্র ও তৃপ্তিকর জলবায়ু প্রদান করিয়াছিলেন, এবং
তাহাদিগকে সাহসী, কর্মঠ ও কষ্টসহিষ্ণু করিয়াছিলেন, মাতৃসেবার সহিত তাঁহারা
বিদ্যারও আরাধনা করিত। চীনপরিব্রাজকগণ তাঁহাদের জ্ঞানগরিমার বিষয় ভূয়োভূয় উলেখ
করিয়াছেন। তাহারাও যেমন মাতৃসেবা করিত, মাতাও তাহাদিগকে তেমনই সুখসম্পদ প্রদান
করিয়াছিলেন। তাঁহাদের সেই সন্তানোচিত মাতৃসেবায় মাতা প্রকৃত সোনার বাঙ্গলা
হইয়াছিলেন, তাই সোনার বাঙ্গলার গৌরব দিগ্দিগন্তে বিকীর্ণ হইয়াছিল।
খৃষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে বা ত্রয়োদশ শতাব্দীর
প্রারম্ভেই বঙ্গভূমিতে মুসলমান্বিজয়নিশান প্রোথিত হয়। পুর্ব্ববঙ্গে কিন্তু তাহার
পর শতাধিক বৎসর পয্যন্ত হিন্দুরাজন্যগণের অধীনেই ছিল। ক্রমে সমগ্র বঙ্গদেশ মুসলমান্
আধিপত্য বদ্ধমূল হয়। মুসলমান্গণ বঙ্গের শ্যামলপ্রান্তরে বাস করিয়া হিন্দুসাধারণের
প্রতিবেশী হইয়া উঠেন। উভয়ের জাতিগত ও ধর্ম্মগত পার্থক্য অনেকদিন পর্য্যন্ত উভয়কে
স্বতন্ত্র করিয়া রাখিয়াছিল। ক্রমে এক দেশে, এক গ্রামে, এক পল্লীতে বসবাস করিয়া
উভয়ের বিদ্বেষভাব অন্তর্হিত হইয়া উভয়েই সোনার বাঙ্গলার সন্তান হইয়া উঠে, উভয়েই
মাতৃসেবায় প্রবৃত্ত হয়, উভয়েই কৃষি বাণিজ্যে মাতৃভুমকিকে সোনার বাঙ্গলা করিয়া তুলে।
হিন্দু ও মুসলমান্ উভয় সন্তানের সেবায় মাতার সমৃদ্ধি দিন দিন বর্দ্ধিত হইতে থাকে।
নানা প্রকার শিল্পে বঙ্গভূমি পরিপুর্ণ হইয়া উঠে। তাঁহার গৌরব দেশে বিদেশে বিঘোষিত
হয়। বহুদেশ হইতে বণিকগণ সোনার বাঙ্গলার দ্র্যব্যসম্ভারগ্রহণের জন্য অসংখ্য
অর্ণবযান লইয়া প্রধান বন্দরসমুহে সমাগত হইত। ভারতবর্ষের সর্বত্র, এশিয়ার বহুদেশে,
এমনকি সুদূর ইউরোপখণ্ড পর্য্যন্ত ইহার শিল্পজাত দ্রব্যসমূহ প্রেরিত হইত।
সোনার বাঙ্গলার এই গৌরবের কথা শুনিয়া দূরদূরান্তর হইতে
বৈদেশিকগণ তাঁহার দর্শর্নাভিলাষে উপস্থিত হইতেন। অনেক বৈদেশিক গ্রন্থে আমাদের
বঙ্গভূমি প্রকৃত সোনার বাঙ্গলারূপেই চিহ্নিত হইয়াছেন। খৃষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর
শেষভাগে ইতালীয় পরিব্রাজক মার্কপোলো এশিয়ার নানাস্থানে পরিভ্রমণ করিয়া চীনদেশে গমন
করিয়াছিলেন। তিনি বাঙ্গালী জাতি ও বাঙ্গালাভাষার উল্লেখ করিয়া ইহার কৃষিবাণিজ্যের
বিষয় বর্ণনা করিয়াছেন। তাঁহার বর্ণনা হইতে জানিতে পারা যায় যে, বঙ্গভূমিতে
পর্য্যাপ্ত পরিমাণে তূলা জন্মিত ও তাঁহার সমৃদ্ধ বাণিজ্য হইত। জটামাংসী, আদা, ইক্ষু
প্রভৃতি অনেক দ্রব্য বঙ্গভূমিতে উৎপন্ন হইত। ভারতবর্ষের অনেক স্থান হইতে বণিকগণ
তাঁহাদের বাণিজ্যের জন্য সমাগত হইত। এইরূপে মার্কপোলো গ্রন্থ হইতে বাঙ্গলা
সম্বন্ধে অনেক বিষয় অবগত হওয়া যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে চিনপরিব্রাজক মাহু বঙ্গদেশে
আগমন করিয়াছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম, সোনার গাঁ, বাঙ্গলা(এই বাঙ্গালানগর অনেক
পরিব্রাজকের গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু ইহার অস্ত্বিত্বসম্বন্ধে বিশেষরূপে
প্রমাণ পাওয়া যায় না। কেহ কেহ ইহাকে কাল্পনিক নগর বলেন, কেহ বা গৌড়ের সহিত অভিন্ন
বলিয়া প্রকাশ করিয়া থাকেন, কেহ বা ইহার স্বতন্ত্র অস্ত্বিত্ব ছিল বলিয়া থাকেন।
তাঁহারা বলেন যে, জলপ্লাবনে উক্ত নগরের ধ্বংস হয়।) প্রভৃতি অনেকস্থান পরিভ্রমণ
করিয়াছিলেন। তাঁহার বিবরণে লিখিত আছে, বঙ্গদেশে নানান প্রকার শস্য উৎপাদন হইত। গম,
তিল, নানাজাতি কলায়, চিনা(চিনি?), আদা, সর্ষপ, পলাণ্ডু, গাঁজা, বার্ত্তাকু,
কাঁঠাল, আম্র, দাড়িম্ব, গুড়, চিনি, কদলী ও নানানপ্রকার ফলোৎপাদনের কথা তিনি উল্লেখ
করিয়াছেন। এতদ্ভিন্ন নারিকেল ও তণ্ডুলজাত মদ্য, তাড়ী ও কাঁজী ও পাঁচ ও ছয় প্রকার
মসলিনের কথা তাঁর বিবরণ হইতে জ্ঞাত হওয়া যায়। মাহু বলেন যে, বঙ্গদেশের অধিবাসিগণ
রেশমী রুমাল, সোনালীকাজকরা টুপী, চিত্রিত মাটীর বাসন, গামলা, পাত্র, সারলৌহ,
বন্দুক, ছুরী, কাঁচী ও বৃক্ষত্বগ্জাত মৃগচর্ম্মের ন্যায় চিক্কণ শ্বেতবর্ণের এক
প্রকার কাগজ ব্যবহার করিত()।
No comments:
Post a Comment