মাস তিনেক আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় জয়াদির এই লেখাটি প্রকাশ পায়। আপাতভাবে লেখাটির বিষয় কামদুনি ঘটনা সংশ্লিষ্ট। হয়ত, হয়ত নয়। কিন্তু তারও বাইরে, ব্যক্তি এবং ব্যক্তির সঙ্গে জুড়েথাকা বৃহত্তর সমাজের নষ্ট হতে বসার যে অশুভ সূচনা শুরু হয়েছে কয়েক দশক ধরে, তাকে উদ্দেশ্য করে মরমী, বিবেকী, ভাষ্য উঠে এসেছে জয়া মিত্রর কলমে।
সহমত হতেও পারেন, নাও হতে পারেন; কিন্তু বোধহয় এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কোথাও না কোথাও বিবেকের মর্মমূল ধরে টান দেবেই।
বিশ্বেন্দু
জয়া মিত্র
সহমত হতেও পারেন, নাও হতে পারেন; কিন্তু বোধহয় এড়িয়ে যেতে পারবেন না। কোথাও না কোথাও বিবেকের মর্মমূল ধরে টান দেবেই।
বিশ্বেন্দু
জয়া মিত্র
আনন্দবাজার পত্রিকা
কলকাতা, ১৮ জুন, ২০১৩
দলতন্ত্রের
দ্বারা ব্যবহৃত হতে হতে আমাদের আত্মজরা হারিয়ে ফেলেছে তাদের মনুষ্যত্ব। সেটা কি কম বড় বিপদ? মা হয়ে আমরা চেষ্টা করব না এই বিষজাল থেকে তাদের সরিয়ে আনার?
এক জন সাধারণ মা হিসাবে এই লেখা লিখছি। লেখা ছাড়া কান্নার, ক্রোধের অন্য কোনও ভাষা জানি না তাই। আমরা যে মনুষ্যদেহ নিজেদের শরীরের মধ্যে রেখে তিলে তিলে তৈরি করি, সাধ্যমত পরমযত্নে তাকে লালন করে বড় করে তুলি, তা কি এই জন্য যে তাদের এক দল অন্য দলকে দেখলে কেবলই ভাববে শারীরিক চাহিদা মেটাবার কথা? কত শারীরিক চাহিদা, কেমন চাহিদা, যে একটি কুড়ি বছরের মেয়ে, জেদ করে স্বপ্ন-দেখা এক কলেজছাত্রী, মরে পড়ে থাকে সর্বাঙ্গে ‘আঁচড়ানো কামড়ানো’র দাগ নিয়ে? ‘দু’দিকে দু’পা টেনে ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা’ করা হবে বলে সন্তানের শরীর বুকে করে যত্ন করি? আমার সন্তান এমন বিকৃতবুদ্ধি হয়ে যাবে যে, সে এই বীভৎসতা করবে একটি মেয়ের শরীর নিয়ে, যা তার বন্ধুর বোনের, এমনকী নিজের বোনেরও হতে পারত?
কেন তবে সন্তানধারণ
করবে এক জন মা? কেন জন্ম দেবে, এ পৃথিবী যদি কোনও মানুষকে নিরাপদে বাঁচতে দেওয়ার যোগ্যতা হারায়? কেন এমন অবস্থায় পৌঁছলাম আমরা? কী করে? দিল্লির সেই মেয়েটিকে যারা হত্যা করেছিল, তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত। বারাসতের এই গ্রামের মেয়েটি অন্তত দেড় বছর ধরে নিত্যদিন ওই একই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করে। রাস্তার আশেপাশে বসে নেশা করা ছেলেরা অন্তত তার মুখ চেনে। হয়তো জানে পরিচয়ও, কেন না এমন বিরাট কোনও জনপদ নয় কামদুনি মোড়। তার পরও মেয়েটিকে... কত বীভৎস যন্ত্রণা সে পেয়েছিল, মরে যাওয়ার আগে? সেই যন্ত্রণায়
ছটফট করা শরীরও নিজেদের শরীর সম্পর্কে কোনও বোধ জাগায়নি ওই পুরুষজাতীয়দের
মনে? তখনও মনে হচ্ছিল ‘উপভোগ’-এর কথা?
এই ঘটনা কেবল কোনও মেয়ের ওপর আক্রমণ, মেয়েদের রক্ষাহীনতার
প্রশ্ন নেই আর। কাগজের ছবিতে মৃতদেহ ঘিরে যে অসংখ্য ছেলে বসে আছেন, যে মহিলারা, যে বাবা-মা’রা, তাঁদের সকলের বিষয়। এঁরা এক পল্লির, এক সমাজের মানুষ। এ রকম সব ঘটনায় তাৎক্ষণিক ভাবে যে ‘দোষীদের ফাঁসি’, ‘দৃষ্টান্তমূলক
শাস্তি’র দাবি ওঠে, বারাসতেও উঠেছে তা। ওঠা হয়তো স্বাভাবিকও। কিন্তু ওই বসে থাকা ভিড়ের মধ্যে আরও অন্য কিছু আছে।
অসম্ভব হতাশ বিষণ্ণতার সঙ্গে যেন এক প্রত্যাখ্যানও।
কোনও রাজনৈতিক দলকে চাননি ওই মানুষরা। চেয়েছেন সুরক্ষা। সুস্থ নিরাপদ জীবনযাপনের
পরিস্থিতি। এই সুরক্ষা দেওয়া রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। এবং মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র বা তার দৃশ্যমান মুখ সরকার, কোনও রাজনৈতিক দল নয়। আমরা জানি, যে কোনও অন্যায়কারী পার পেয়ে যায়, কারণ কোনও না কোনও রাজনৈতিক দল তাকে আশ্রয় বা সমর্থন দেবে। গত অন্তত চার দশক ধরে এই ভয়ঙ্কর ক্ষয় এ রাজ্যের সবচেয়ে বড় ব্যাধি। এ দেশে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের মাঝখানে সমাজের এক ভূমিকা ছিল। সত্তর দশক থেকে আমরা দেখলাম সমাজের সেই ভূমিকা ধীরে ধীরে গৌণ হয়ে গেল। তার জায়গা নিল পার্টি। দাম্পত্য সমস্যা থেকে এলাকার পানীয়জল পর্যন্ত সর্বত্র ‘পাড়ার পাঁচ জন’, এমনকী আত্মীয়পরিজনদের
কাছেও সমস্যা নিয়ে যাওয়া অ-চল হয়ে সর্বসমস্যার সুরাহা হতে লাগল পার্টির হস্তক্ষেপে।
পাড়ার ক্লাবগুলোর চরিত্র পালটে গেল, লাইব্রেরিগুলো বন্ধ হয়ে গেল, রকের কিংবা পাড়ার মোড়ের আড্ডাও হয়ে উঠল নিয়ন্ত্রিত।
সেই নিয়ন্ত্রণের শীতল ভয়ে পিছনের বেঞ্চে চলে যাওয়া সমাজ চুপ হয়ে গেল। পল্লির সমাজ স্থানিক। সেই সমাজ স্থানীয় লোকদের নির্দিষ্ট ভাবে জানে, সমস্যা সমাধানের উপায় খুঁজতে গিয়ে নানা জনের মত দেওয়ার সুযোগ থাকে, এমনকী অগ্রাহ্য করারও। পার্টির ছত্রচ্ছায়ায় থাকা স্থানীয় কর্মীও পাড়ারই, কিন্তু তার দায় ও স্বার্থ অন্যত্র লগ্ন। সেখানে কোনও অন্য মতের বা অমান্যতার ঠাঁই নেই। দলতন্ত্রের নামে এই সর্বব্যাপী
অনৈতিকতা এক দিনে হয়নি। আমরা চুপ করে থেকেছি। মেনে নিয়েছি। আমাদের অপ্রতিরোধে এই বিষ সমাজের আদ্যন্ত খেয়ে ফেলতে উদ্যত হয়েছে। এই ক্ষমতা-কাঠামোর, দুর্নীতি ও অন্যায়ের স্পর্ধা বাড়তে বাড়তে কত দূর গিয়েছে, বারাসতের নৃশংসতা তার চেহারাটা আবার খুলে দেখাল। আবার মনে পড়ল ধানতলার কথা। মনে পড়ল এই অন্যায়েরও বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দ্বিধার কথা, রাজনৈতিক পার্টির নাম হিসাব করে।
যে মানুষরা ছবিতে বসে আছেন মৃত মেয়েটির দেহ ঘিরে, তাঁরা কি কোনও নতুন রাস্তার কথা বলছেন? বিপন্ন শুধু আমাদের কন্যারা নয়, আত্মজরাও— যে কিশোর তরুণ যুবারা বিকৃতবুদ্ধি
নেশাগ্রস্ত, ব্যবহৃত হচ্ছে পার্টির ক্ষমতাধরদের
পা মোছার ছেঁড়া চট হিসাবে। এলাকার ওপর দখল বজায় রাখা, জমির মাফিয়াগিরি, নানা রকম বেআইনি, অনৈতিক কাজ করার জন্য এলাকায় সন্ত্রাস বহাল রাখা— এ সব কাজ এদের দিয়েই করানো হয়, যাদের সুস্থ স্বাভাবিক জীবিকার সমস্ত পথ বন্ধ হয়ে গিয়েছে ক্ষমতার দাপটে। গুন্ডাগিরি করা, অসামাজিক জীবন যাপন শহরতলির এই তরুণদের কাছে খোলা রাস্তা। স্থানীয় সব পার্টির নেতারা কুড়ি বছর ধরে একটা পুরো প্রজন্মকে কেবল ব্যবহার করে চলেছেন। তার পর যখন এরা মাত্রাছাড়া
অন্যায় করে, তখন ‘এরা আমাদের নয়’ বলে হাত ধুয়ে ফেলা হয়। এরাও ভয়াবহ ভাবে বিপন্ন এক জনদের শরীর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, অন্যদের মানবজন্মের
সেরা গুণ মানবিকতা। এ জন্য বেড়ে ওঠেনি তারাও যে ক্ষমতা আর বাজার হাত ধরাধরি করে তাদের পিঠে-মাথায় পা দিয়ে আরও ওপরের দিকে উঠে যাবে। চোখের সামনে প্রতি দিন দেখছি কোনও রাজনৈতিক পার্টি একে অন্যের চেয়ে ভিন্ন নয়। নিজেদের কোনও আদর্শের কথাও বলে না এরা, বলে কেবল ছোট থেকে বড় ক্ষমতা দখল করার কথা। আমরা কি নিজেদের সন্তানদের সরিয়ে আনবার চেষ্টা করব ওই বিষজালের বাইরে? যেমন ভাবে ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে, অসুস্থতার হাত থেকে ছেলেমেয়েদের রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন মা-বাবা? আমরা কি সেই ভাবে চেষ্টা করব আবার? এক এক করে বাঁচতে, ধরে ধরে বাঁচাতে?
আজ এই যন্ত্রণার মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে হয়তো একেবারে একা দাঁড়াতে হবে না। কঠিন, খুব কঠিন, কিন্তু উন্মাদ ক্ষমতার চোয়াল থেকে সন্তানদের মুক্ত করে আনা একেবারেই কি অসম্ভব?
আজ এই যন্ত্রণার মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছে হয়তো একেবারে একা দাঁড়াতে হবে না। কঠিন, খুব কঠিন, কিন্তু উন্মাদ ক্ষমতার চোয়াল থেকে সন্তানদের মুক্ত করে আনা একেবারেই কি অসম্ভব?
No comments:
Post a Comment