হিমালয়কেও বাজারে বিক্রির সিদ্ধান্ত হল। এবং তা হল স্থানীয় মানুষদের বিরোধিতায়, সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়।
এই বিপর্যয় তার পরিণাম। একে দয়া করে ‘আকস্মিক’ বলবেন না।
জয়া মিত্র
কলকাতা, ২৬ জুন, ২০১৩
কলকাতা, ২৬ জুন, ২০১৩
উত্তরাখণ্ডের
সাম্প্রতিক জলপ্রলয়কে যে ভাবে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে বর্ণনা করা হচ্ছে, সেটা বিভ্রান্তিকর। ক্ষতিকরও। মৃতের প্রকৃত সংখ্যা পাঁচ হাজার না তার অনেক বেশি, কত ভয়ংকর অভিজ্ঞতা পেরিয়েছেন বেঁচে ফেরা লোকেরা, কত ক্ষয়ক্ষতি
হল রাস্তার, কী অসাধারণ সাহস ও ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর
উদ্ধারকারী দল এ সব নিয়ে অনেক আলোচনা, আত্মার শান্তিকামনা,
দুর্গতদের সাহায্য-প্রচেষ্টা, সবই নিশ্চয়ই চলতে থাকবে, চলারই কথা। কিন্তু ‘বিপর্যয়’ শব্দটির মধ্যে কোথাও আকস্মিকতার
অর্থ নিহিত থাকে। উত্তরাখণ্ডে যা ঘটেছে, তাকে আকস্মিক বলা যাবে না। একটা বহুতল বাড়ির বেসমেন্টে আগুন লাগিয়ে দিয়ে দশতলার মানুষদের মৃত্যুকে ‘আকস্মিক’ বলাটা কি সঙ্গত?
ধস ও জলোচ্ছ্বাসের
অঞ্চলটির দিকে খেয়াল করলেই অনেকটা পরিষ্কার হবে যে, পাহাড়ের এই চূড়ান্ত দুর্যোগ অবশ্যম্ভাবী
ছিল। যে ক্লাউডবার্স্ট
বা মেঘভাঙা-র কথা বলা হচ্ছে, তা হিমালয়ে কুমারসম্ভবের
কাল থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু গঙ্গা ও তার প্রধান দুই উপনদী মন্দাকিনী ও অলকানন্দা, এই ত্রিভুজ অববাহিকা গত পনেরো-কুড়ি বছরে যে যথেচ্ছাচারের
শিকার হয়েছে তা হিসাববিহীন। জানা যাচ্ছে, কুড়ি বছর আগে এই অঞ্চলের রাস্তায় গাড়ি চলত দৈনিক হাজার থেকে দেড় হাজার। এখন সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছে ষাট-সত্তর হাজার। বেশি অর্থবান মানুষরা যাতে কম সময়ে বিনা পরিশ্রমে যথেষ্ট পুণ্য করে আসতে পারেন, তাই হেলিকপ্টারের চক্কর চলে দৈনিক ৬০০ থেকে ৭০০ বার। এই জ্বালানি নির্গত কার্বনের কী প্রভাব পড়ে ওই সূক্ষ্ম ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের ওপর? অন্তত হাজার বছর ধরে লোকজন ওই পাহাড়ে, নদীর কিনারে ছোট-ছোট গ্রামে বাস করেন। সমতল থেকে শত শত বছর ধরে সন্ন্যাসী বা তীর্থযাত্রীরা
হিমালয়ের পথে পথে ভ্রমণ করেছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁরাই আবিষ্কার করছেন প্রকৃতির এক একটি পরমাশ্চর্য,
তা-ই হয়ে উঠেছে দেবস্থান। তীর্থ। কখনও তা হিমবাহের কিনারে উষ্ণ প্রস্রবণ, কখনও বিজন উচ্চতার গুহার মধ্যে বরফের শিব লিঙ্গপ্রায় অবিনির্মাণ,
কোথাও তুষারশিখরের আড়ালে আশ্চর্য ফুলের বন আর নদী।
হিমালয়ের সবচেয়ে বেশিসংখ্যক
তীর্থ কোনও না কোনও ভাবে নদীর সঙ্গে সম্পর্ক ধরে থাকে। একভাবে বলা যায়, এখানকার বাসিন্দারা
এবং বাইরে থেকে যাওয়া মানুষরাও প্রাকৃতিক এই পরমাশ্চর্য সংস্থানের গুরুত্ব এত বেশি বুঝতেন, যে তাঁদের কাছে সমগ্র অঞ্চলটিই ছিল পবিত্র। সযত্নে সসম্ভ্রমে রক্ষা করার। এমনকী পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত গাড়োয়াল কুমায়ুনে যে সব রাস্তা তৈরি হয়েছে, পাহাড়ের ভঙ্গুরতা খেয়াল রেখে সেখানে ব্যবহৃত হয়েছে গাঁইতি-শাবল।
স্কুলপাঠ্য
বইয়েও লেখা থাকে যে, হিমালয় পৃথিবীর নবীনতম পর্বত, এখনও তা সুস্থিতিশীল হয়ে ওঠেনি। তা সত্ত্বেও গত কুড়ি-তিরিশ বছরে এ দেশের অন্যান্য দুর্লভ প্রাকৃতিক সম্পদের মতোই হিমালয়কেও মাঝ-বাজারে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত হল। এবং তা হল স্থানীয় মানুষদের বিরোধিতায়, দেশের ও রাজ্য সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। ভারতের ভূ-তত্ত্বে, প্রাকৃতিক অবস্থানে, জলবায়ুর স্বভাব নির্ধারণে হিমালয় পর্বত ও তার নদী-সংসারের উপস্থিতি যে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে, সেই গুরুত্বকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে এই পর্বতমালাকে
তাত্ক্ষণিক খুচরো লাভের জন্য বেচা শুরু হল। বন্যার বিবরণে জানা যাচ্ছে, অন্তত ১২০০ জায়গায় রাস্তা ভেঙে গেছে, ভেসে গেছে অন্তত ১৪৮টি সেতু। ঘোর বর্ষাকালে ৫৫ হাজার থেকে ১ লক্ষ লোক ছিলেন সমস্ত এলাকাটিতে। এক-একটি ভ্রমণ সংস্থা ৫০-৬০ জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষকে নিয়ে এসেছে। এঁরা কিন্তু সে রকম মানুষ নন, যাঁরা লাঠি-হাতে পদব্রজে পাহাড়ের রাস্তায় হাঁটতে পারেন। এই লক্ষ লক্ষ পর্যটক, যাঁরা এই বিশাল দেশের যে-কোনও জায়গায় বেড়াতে যেতে পারতেন তাঁদের সকলকে কেন আনতেই হবে ‘বিনা আয়াসে চারধাম’ ভ্রমণ করাতে? ট্যুরিজম’কে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ করে তুলতে হবে সেই সব অঞ্চলেরও জন্য, যেখানকার ভূ-প্রকৃতি এত ধকল সহ্য করতে পারবে না, সেখানেও? যেখানকার শান্ত স্থিতিশীল সমাজ ট্যুরিজমের আলগা টাকা প্রার্থনা করেনি, সেখানেও? গাড়োয়াল হিমালয়ের বিপুল নদী-অবতরণকে স্থাপকতা দিয়ে ভূস্খলন প্রতিরোধ করত এখানকার গভীর অরণ্যানী। রাস্তা, বাঁধ, হোটেল, রিসর্ট, বহুতল ধর্মশালা তৈরির জন্য যথেচ্ছ বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে এই ধর্মপ্রবণ অঞ্চলে। স্থানীয় লোকেদের উন্নয়নের নামে ধ্বংস হয়েছে তাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতি। ২০১০ সালের গ্রীষ্মে মাইলের পর মাইল জুড়ে রুদ্রপ্রয়াগ
থেকে পৌরি, ল্যান্সডাউন
পর্যন্ত আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে অরণ্যে। অসংখ্য বিস্ফোরণে আপাদমস্তক পাহাড় কাঁপিয়ে তৈরি হয়েছে পাকা রাস্তা। গৌরীকুণ্ড, গঙ্গোত্রী, হরশিল, জানকীচটি প্রতিটি সংকীর্ণ ভঙ্গুর গিরিপ্রস্থে
তৈরি হয়েছে ছ’তলা, আটতলা বিশাল সব হর্ম্য। একসঙ্গে হাজার আরামে থাকার জায়গা। এই ট্যুরিজম শিল্পের অনিয়ন্ত্রিত
অপরিণামদর্শী বিস্তারের পরিণামে ধ্বংস হয়ে গেল বহু জায়গায় পাহাড়ের স্বাভাবিক ঢাল, জঙ্গল।
No comments:
Post a Comment