ইংরেজ আমলে কলকাতায় আশ্রয়
নেওয়া বাঙালির নুনের ব্যবসায় নজর ফেলে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, সরকার অথবা রাষ্ট্র
নিয়ন্ত্রিত লবন মহলে, লবন উত্পাদন করে কলকাতায় নিয়ে এসে বিপুলপরিমান লবন
নীলামবাজারে তুলেদিয়েই হাত ধুয়ে ফেলত ইংরেজ। বাজার থেকে ইংরেজ আশ্রিত বাঙালি
নানান পাইকার, সেই লবন নীলাম বাজার থেকে কিনে তার গোষ্ঠীভূক্ত ব্যবসায়ী মার্ফত
ছড়িয়ে দিতেন জেলার বাজারে, জেলার পাইকারদের হাতে, যার উল্লেখ বিশদে করা হয়েছে
আগেই।
জেলার পাইকারদের কাছ থেকে কিনে নিয়ে আরও একধরণের ব্যবসায়ীরা লবন ছড়িয়ে দিতেন
নানান আঞ্চলিক বাজারে। কলকাতার বাজারে যিনি খুচরো ক্রেতা তিনি আবার জেলার
বাজার পাইকার। এই আঞ্চলিক বাজার থেকে আরও গভীরে পণ্য পরিবহন করে নিয়ে
যেতেন কিন্তু পথ ব্যবসায়ীরাই। শুধু নুনই নয়, হাজারো উত্পাদকের
পণ্যদ্রব্য বাঙলা তথা ভারতের নানান গ্রামে গঞ্জে পথে প্রান্তরে পৌঁছে দিতে মাহির
ছিলেন এই তৃণমূস্তরের পথ ব্যবসায়ীরা।
ভারতবর্ষের মূল সামাজিক দর্শণ
আলোচনার সময় আমরা দেখেছি, ভারতের হাজারো সমাজ নিদেরমত করে শাসনের নীতি তৈরি করে
নিয়েছিল। কোনও শাসকের
উপায় ছিলনা সেই স্বশাসিত ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে। নিজেদের
শাসন এলাকায় গ্রামীণরা নিজেরই স্বরাট। প্রত্যেকটি গ্রামগোষ্ঠী উত্পাদনের
সঙ্গে প্রশাসনকর্মেও ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। একটি সমাজের শাসননীতি অন্যসমাজের
সেই নীতির সঙ্গে নানান ধারায় নানাবিধ পার্থক্য থাকতেই পারত, সেটাইছিল স্বাভাবিক। শুধু একটি
মৌলিক বিষয়ে ভারতের গ্রামগোষ্ঠীগুলি একাট্টা ছিল সেটি হল স্বশাসিত শাসন ব্যবস্থা। ভারতীয়
সমাজের নানান বিভাগ সাধারণে অসাধারণ বিকেন্দ্রিকতার দর্শণ নিষ্ঠাভরে পালন করত। এবং সে
অর্থে কোনও কেন্দ্রিভূত শক্তিদ্বারা চালিত
হত না বলেই মস্ত এক সভ্যতার রথের চাকা গড়গড়িয়ে চলেছে হাজার হাজার বছর ধরে। পশ্চিমি
লুঠভিত্তিক শিল্পবিপ্লবজাত সভ্যতারমত কয়েক শতকেই ভেঙেপড়ার অবস্থা হয় নি। তাকে
ধংসকরতে গিয়ে লড়াই চালাতে হয়েছে প্রায় একশতাব্দ।
এই অকেন্দ্রিভূত সভ্যতার
অন্যতম বড়, গুরুত্বপূর্ণ অংশিদার ছিলেন আমাদের আলোচ্য তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীরা,
যারা সমাজের মৌল দর্শণবিন্দুটুকু মেনে সমাজের নানান উত্পাদন পৌঁছে দিতেন অন্যান্য
সমাজের দোর গোড়ায়। বংশপরম্পরায় তাঁরা এই কাজটি করতে গিয়ে নিজেদেরমতকরে
একটি ব্যবসাভিত্তিক জ্ঞাণভান্ডার রচনা করতে পেরেছিলেন, যার মৌল উদ্দেশ্য ছিল
সমাজেরমধ্যে মানুষে মানুষে যতটাসম্ভব সাম্যবোধেরভাব তৈরি করা। বড়
পাইকারি ব্যবসার অন্যতম অন্তর্নিহিত দর্শণ মানুষে মানুষে বিভেদ, কেন্দ্রিকতা আর
অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্যক্তির অথবা সংস্থার অতিরিক্ততম মুনাফা অর্জণ। সব থেকে
বড় কথা এই শহর কেন্দ্রিক বড় ব্যবসাগুলির সঙ্গে ভারতীয় সমবায়ী সমাজগুলির
মৌলকাঠামো দর্শণের বিন্দুমাত্র মিলমিশ ছিলনা। শহুরে বড়
ব্যবসায়ীদের ব্যবসা দর্শণএর অন্যতম উদ্দেশ্য হল মানুষে মানুষে বঞ্চনা আর বিভেদ
সৃষ্টি আর ব্যবসার মাধ্যমে অমিত ঐশ্বর্য নিজের হাতে আনয়ণ।
অথচ ঠিক উল্টো দর্শণে বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু ভারতীয়
তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীরা। তাঁদের অন্যতম দর্শণ
মানুষের মধ্যে বেঁচে থাকা, মানুষকে নিয়ে বাঁচা। দৈনন্দিনের নানান চাহিদাবস্তুগুলি তাঁরা মানুষের দোরে
দোরে পৌঁছনোর কাজ করতেন সমবায়ী সমাজের বিকেন্দ্রিকতার সূত্র মেনেই। এঁদের কাজে মুনাফা একটা বড় ব্যাপারছিল সন্দেহ নেই,
কিন্তু এঁরা কেউই কিন্তু দার্শণিকভাবে সবমুনাফা একহাতে নিয়ে আসার বিরোধী ছিলেন,
আজও আছেন। এর আগে সোনাধর
বিশ্বকর্মার উদ্যম আলোচনায় দেখেছি সনাতন সমবায়ী সমাজ ব্যক্তির হাতে অতিরিক্ত পুঁজি
কেন্দ্রিভূত হওয়ার নীতির ঘোরতর বিরেধী ছিল।
No comments:
Post a Comment