বার্ণিয়ের ন্যায় টাভার্ণিয়েও বাঙ্গলার অনেক পণ্যদ্রব্যের
বিষয় উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি প্রথমত ইহার রেশমের বিষয় উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন যে,
ইহার অন্তর্গত কাশিমবাজার হইতে বিশহাজার গাঁইট রেশমের রপ্তানী হয়। ওলান্দাজগণ ছয়
সাত হাজার গাঁইট চালান দিয়া থাকে। তাতার দেশীয় ও অন্যান্য বণিকেরাও ইহার ব্যবসায়
করিয়া থাকে, এই সমস্ত রেশম গুজরাট, আমেদাবাদ ও সুরাট প্রভৃতি স্থানে প্রেরিত হয়
এবং এতদ্দেশে তদ্দারা বস্ত্রাদিও নির্ম্মিত হইয়াথাকে। কাশীমবাজারবাসিগণ তাহাকে
শ্বেতবর্ণ করিয়াও থাকে। ওলান্দাজেরা সেই সমস্ত রেশম হুগলী পর্য্যন্ত লইয়া গিয়া
জাহাজে বোঝাই করে। বঙ্গদেশে সাদা কার্পাসথানও প্রস্তুত হয়। এখান হইতে নীলেরও
রপ্তানী হইয়া থাকে। বঙ্গদেশে লাক্ষাও জন্মে। তদ্দারা বস্ত্রাদি রঞ্জিত হয়। এখান হইতে অনেকপরিমাণ চিনির রপ্তানী হইয়া থাকে। হুগলী, পাটনা, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে তাহার
বাণিজ্য হয়।
বার্ণিয়ে ও টাভার্ণিয়ের বর্ণনা হইতে অবগত হওয়া যায় যে,
তৎকালে ইউরপিয়গণের মধ্যে ওলান্দাজগণই বঙ্গদেশে অধিক পরিমাণে বাণিজ্যকার্য্যে লিপ্ত
ছিল। কিন্তু তৎকালে ইংরেজ প্রভৃতি অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকগণও এতদ্দেশের সহিত
বাণিজ্যকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। ইংরাজদিগের বাণিজ্যকার্য্যের বিষয় ও তাহাদের
দ্বারা কিরূপে এতদ্দেশের বাণিজ্যের স্রোত রুদ্ধ হইতে আরম্ভ করে, আমরা আরও সে
বিষয়ের উল্লেখ করিব (কিন্তু আমরা, লোকফোক তার পুস্তকের এই অংশ অন্ততঃ এই বার প্রকাশ করছি না);
ইংরাজরা এতদ্দেশে বাণিজ্যার্থে উপস্থিত হইলে তাহাদের বহুসংখ্যক বাণিজ্যজাহাজ বঙ্গদেশে আগমণ করিত এবং তাহা পণ্যদ্রব্যে পরিপুর্ণ হইয়া দেশবিদেশে প্রেরিত হইত। এই সমস্ত জাহাজের আরোহিগণ বঙ্গদেশের যেরূপ বিবরণ প্রদান করিয়াছেন, তন্মধ্যে টমাস-বাউরী নামক একজন কাপ্তেনের বর্ণনা আমরা এস্থলে উদ্ধৃত করিতেছি। বাউরী ১৬৬৯ হইতে ৭৯ পর্য্যন্ত এদেশে অবস্থিতি করিয়াছিলেন।
ইংরাজরা এতদ্দেশে বাণিজ্যার্থে উপস্থিত হইলে তাহাদের বহুসংখ্যক বাণিজ্যজাহাজ বঙ্গদেশে আগমণ করিত এবং তাহা পণ্যদ্রব্যে পরিপুর্ণ হইয়া দেশবিদেশে প্রেরিত হইত। এই সমস্ত জাহাজের আরোহিগণ বঙ্গদেশের যেরূপ বিবরণ প্রদান করিয়াছেন, তন্মধ্যে টমাস-বাউরী নামক একজন কাপ্তেনের বর্ণনা আমরা এস্থলে উদ্ধৃত করিতেছি। বাউরী ১৬৬৯ হইতে ৭৯ পর্য্যন্ত এদেশে অবস্থিতি করিয়াছিলেন।
বাউরী বলিয়াছেন তাঁহার সময় বাঙ্গলা অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী
হইয়া উঠিয়াছিল। গঙ্গা ও তাহার শাখানদীসমূহের তীরবর্ত্তী গ্রাম ও শস্যশ্যামল
ভূমিতে ইক্ষু, কার্পাস, লাক্ষা, মধু, মোম, ঘৃত, তৈল, ধান্য, বুট প্রভৃতি অনেক
পণ্যদ্রব্য জন্মিত। ইংরেজ ওলান্দাজ ও পর্টুগিজগণের ক্ষুদ্র ও বৃহৎ জাহাজসমূহ এই
সমস্ত দ্রব্যে পরিপূর্ণ হইয়া ভারতের নানা স্থানে, পারস্য, আরব, চীন ও দক্ষিণসমুদ্রের
অভিমুখে যাত্রা করিত। এই সমস্ত পণ্যদ্রব্য ব্যতিত নানাপ্রকার কার্পাসনির্ম্মিত
থান ও ছিট, রুমাল, রেশম, রেশমীবস্ত্র, অহিফেন, মৃগনাভি, লঙ্কা প্রভৃতি দ্রব্যও
উৎপন্ন হইত। নবাব সায়েস্তা খাঁ এবং বণিক্গণ ঢাকা, বালেশ্বর, পিপলী প্রভৃতি স্থান
হইতে বংশতি পালের জাহাজ বণিজ্যার্থে সিংহল, টেনাসরিম প্রভৃতি স্থানে প্রেরণ
করিতেন। ঐ সমস্ত জাহাজ হস্তী আনয়ণ করিত ও মালদ্বীপ হইতে কড়ি প্রভৃতি আনিত। বাউরী
কাশীমবাজারকে বাঙ্গলার সর্ব্বপ্রধান বন্দর বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। ইহার আড়ঙে
সর্ব্বপ্রকার পণ্যদ্রব্যের আমদানী রপ্তনী হইত বলিয়া তিনি বর্ণনা করিয়াছেন।
এইরূপে বঙ্গভূমি বহু প্রাচীন কাল হইতে ধনধান্যে
পরিপুর্ণ হইয়া বাণিজ্য ও স্বাস্থ্যগৌরবে প্রকৃত সোনার বাঙ্গলারূপেই পরিচিত ছিল।
স্বাধীন হিন্দু নরপতিগণের রাজত্বাবসান হইলেও বঙ্গভূমিতে অন্নের হাহাকার পড়ে নাই।
মুসলমানরাজত্বকালেও সোনার বাঙ্গলার মস্তকে অশেষ কল্যাণ বর্ষিত হইত। নবাব সায়েস্তা
খাঁ ও সুজাউদ্দীনের সময় টাকায় ৮ মণ ও মুর্শিদকুলী খাঁর সময় টাকায় ৪ মণ চাউল
বিক্রীত হইত। তখনও ইহার শিল্পবাণিজ্যগৌরব সমগ্র এশিয়া ও ইউরোপের বিস্ময় উৎপাদন
করিত। ইহার হিন্দু অধিবাসিগণের বাসভবনের অদূরে মুসলমানগণ বাস করিয়া সানন্দে
কালযাপন করিত। ধর্ম্মবিদ্বেষ প্রথম কিছুকাল উভয়জাতির হৃদয়ে নানা তরঙ্গের উদয়
করিয়াছিল বটে, কিন্তু পরিণামে শান্তভাব ধারণ করে। উভয়জাতির নানা সম্প্রদায় আপন আপন
জাতীয়ব্যবসায় অবলম্বন করিয়া উদারন্নের ব্যবস্থা করিয়া লইত। এই উভয় জাতির হস্তপ্রসূত
অসংখ্য পণ্যদ্রব্য অর্ণবযানে দেশবদেশে নীত হইত। সর্ব্বাপেক্ষা কার্পাসসূত্র হইতে
তন্তুবায় ও ব্রাহ্মণ পরিবার পর্য্যন্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করিতেন। কৃষকেরা ইহার চাষে,
তন্তুবায়েরা বস্ত্রবয়নে, আর অন্যান্য জাতি ইহার সূত্রকর্ত্তনে নিযুক্ত হইত।
প্রত্যেক সাধারণ গৃহস্থের ভবনে কার্পাসবস্ত্রবয়নরূপ মহাযজ্ঞের জন্য
অল্পবিস্তরায়জন হইত। অন্যান্য দ্রব্যেরও কৃষি ও শিল্পে ইহার অধিবাসিগণ মনোযোগ
দিত। তাই বঙ্গভূমি শস্যশ্যামলা ও শিল্পবাণিজ্যগৌরবে গরীয়সী ছিল। ইহার প্রত্যেক
গ্রামে স্বাস্থ্যের কল্যাণকারী ছায়া বিস্তৃত হইত। শ্যামল বৃক্ষরাজির তলে বসিয়া
পল্লীবাসিগণ শারীরিক পরিশ্রমে আপনাদের জীবিকার উপায় করিত। বর্ত্তমান সময়ের
বাঙ্গলির ন্যায় তাঁহারা শীর্ণদেহ ও কঙ্কালাবশেষ ছিল না। তাহাদের বাহুতে অপরিসীম
শক্তি ছিল। সময়ে সময়ে তাঁহারা সে বাহুবলের পরিচয়ও প্রদান করিয়াছে। একদিন তাঁহারা
আপনাদের বাহুবলের পরিচয় করিবার জন্য পাঠান, মোগল, মগ ও ফিরিঙ্গির সহিত অসি যুদ্ধ ও
অগ্নিক্রীড়া করিয়াছিল। ইহা কাহিনী নহে ইতিহাস। মুসলমান ও পাশ্চাত্য লেখকগণ
বাঙ্গলার এই বাহুবলের কথা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করিয়াছেন। ভারতের ইংরেজশাসনকর্ত্তগণ
বাঙ্গালীর যে অপবাদ দিয়া জগতের সমক্ষে তাঁহাদিগকে হেয় বলিয়া প্রচার করিয়া থাকেন
ইতিহাস তাহা স্বীকার করে না। বাঙ্গালীর এরূপ অধঃপতনের কারণ ভারতে ইংরেজশাসননীতি ও
আমাদের চিত্তদৌর্বল্য। যে বাঙ্গালিগণ স্বর্গীয় স্বাস্থ্যে বলশালী হইয়া দুর্ধর্ষ
শত্রুগণের সম্মুখীন হইতে পশ্চৎপদ হইত না, আজ তাঁহারা কঙ্কালাবশেষ প্রেতমূর্ত্তি
ব্যতীত আর কিছুই নহে, যাহার প্রত্যেক পল্লীতে শান্তিদেবী বিরাজ করিতেন, যাহার গৃহ
হইতে এককালে রামায়ণ, চণ্ডী ও কীর্ত্তনের আনন্দগীতি অনন্ত আকাশ স্পর্শ করিবার জন্য
উত্থিত হইত, আজ তাহা শৃগাল পেচকের ধ্বনিতে মুখরিত, যাহার পল্লীললনাগণ স্বদেশী বস্ত্রের
অন্তরাল হইতে আপনাদের লাবণ্যবিকাশ করিয়া দেবীমূর্ত্তিরূপে বিরাজ করিতেন, আজ
বিদেশীয়বস্ত্রে তাঁহারা আপনাদের কর্কশকায় আবরণ করিবার জন্য ব্যগ্র! যাহার প্রত্যেক
নগরে ও গ্রামে হাস্যমুখ অধিবাসিগণ স্ব স্ব জাতি ও সম্প্রদায়ানুমোদিত কৃষি, শিল্প ও
বাণিজ্যে স্বচ্ছন্দচিত্তে বাস করিত, এক্ষণে তাহার সর্ব্বত্র উদরান্নের সংস্থানের
জন্য হাহাকারের রোল উঠিয়াছে, আজ জীবন সংগ্রামে সকলেই আহত। কোথায় সে স্বাস্থ্য, কোথায়
সে শান্তি, কোথায় সে কল্যাণ! আজ সোনার বাঙ্গলা শ্মশান ভূমি! কেন এমন হইল, আমরা পরে
তাহার উল্লেখ করিতেছি।
No comments:
Post a Comment