কয়েকদিন আগে এই সময়ের ক্রোড়পত্র রবিবারয়ারির নিচে উল্লিখিত সংখ্যায় তাসের বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে এই পাতারই সাপ্তাহিক কলমচি সুরজিত সেন দু লাইনে নিদান দিয়ে দেন যে তাসের প্রচলন ভারতে করেছে পর্তুগিজরা। এ সম্বন্ধে কলাবতী মুদ্রা এবং লোকফোকের ভাবনা তুলে দেওয়া গেল। বলা দরকার এই চিঠিটি কাগজ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে অন্ততঃ ১৫ দিন আগে। এ বিষয়ে তাঁদের নীরবতা বিস্ময়কর।
বিশ্বেন্দু নন্দ, কলাবতী মুদ্রা, কলকাতা
মাননীয়,
সম্পাদক, এই সময়, কলকাতা
এই
সময়ের ক্রোড়পত্র, রবিবারোয়ারি(৪/৮/২০১৩) সংখ্যার শেষ পাতায় সুরজিত সেনমশাইএর
ভারতীয় তাসের বিকাশ বর্ণনায় যে তথ্য দিয়েছেন, তা ইওরোপমুখ্য ঐতিহাসিকদের মত।
সুরজিত সেনমশাই সিদ্ধান্তই করে ফেলেছেন, ভারতের তাস খেলা বিদেশ থেকেই এসেছে,
‘আমাদের দেশে তাস কবে প্রথম এসেছে তা সঠিক জানা না গেলেও...’ স্তবকটি তার প্রমান।
তাই তার কলম চলে গিয়েছেন সহজপ্রাপ্য চিন মুঘল তাসের ইতিহাসের পানে। কিন্তু এই পোড়া
বাংলাতেই ১১৮ বছর আগের অন্য মত জেগে রয়েছে। সেটি আজ খুব হাতের কাছে থাকা। সে মত
কোনও অর্বাচীন সংস্কৃতি কর্মীদের নয়, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আর বিনয় ঘোষেরমত প্রথিতযশা
দুই গবেষকের। এই লেখা, দুই দেশাভিমানী মানুষের ভাবনা সংগৃহীত করে গঙ্গা জলে গঙ্গা
পুজো। এটি যদি আপনাদের চিঠিপত্র বিভাগে প্রকাশ করেন তাহলে বাঙলায় তাস খেলা নিয়ে
চলতে থাকা ইওরোপমুখ্যতা কিছুটা হলেও অপনোদন হতে পারে।
প্রচলিত ইওরোপমুখ্য ভারতীয় ইতিহাস বলছে পর্তুগিজদের হাত ধরে ভারতে তাস খেলার উদ্ভব। কিন্তু বাংলার ইতিহাস বলছে, রাঢে মল্লরাজাদের সমৃদ্ধিকালে দশাবতার তাসের আর তাস খেলার প্রবর্তন হয়।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমশাই ১৮৯৫ সালের(আজ থেকে ১১৮ বছর আগে)
এসিয়াটিক সোসাইটির জার্নালের এক ছোট্ট নোটে লিখছেন
...I fully believe that the game was invented about eleven or twelve hundred
years before the present date. শাস্ত্রীমশাই-এর হিসেব অনুযায়ী এই খেলার উদ্ভব
সপ্তম-অষ্টম শতক। প্রথম কারন,
আজকের ভারতের প্রচলিত দশাবতার বিশ্বাসে
জগন্নাথ বা বুদ্ধের স্থান নবম - কল্কীর(স্মরণ করা যাক
কবি কোকিল জয়দেবের দশাবতার শ্লোকাবলী - প্রলয়
প্রলয়ধি জলে-র বুদ্ধসংক্রান্ত
শ্লোকটি) আগে। কিন্তু দশাবতার তাস অনুযায়ী জগন্নাথ বা বুদ্ধদেবের স্থান পঞ্চম।
শাস্ত্রীমশাইএর যুক্তি ধরে বলাযায়, বাংলায় এমন এক সময়ে দশাবতার তাসের খেলার
প্রবর্তন হয়েছিল, যখন বুদ্ধদেব পঞ্চম অবতার রূপে গণ্য। তাসে বুদ্ধমুর্তি আদতে জগন্নাথ মূর্তি, -
কেবল মাথা ও হাতসহ দেহকাণ্ডের মূর্তি। সুতরাং জীবের ক্রমবিকাশেরস্তরে নৃসিংহ(অর্ধ
নর অর্ধ পশু) এবং বামনের (পূর্ণ নর) মধ্যবর্তী স্থান পেয়েছেন তিনি – অর্থাত
নিম্নতম জীব মত্স্য থেকে পূর্ণ মানব পর্যন্ত বিকাশের ইতিহাসের একদম মাঝখানটি
অধিকার করে আছেন তিনি।
বিনয়
ঘোষমশাই এই বিকাশকে ভারতীয় চিহ্ণতত্বের
বিকাশের দৃয্টিভঙ্গী হিসেবেও দেখেছেন। দশাবতার তাসে বুদ্ধের প্রতীক পদ্ম। অর্থাত্
এই তাসটি এমন সময় বিকাশ হয় যখন বুদ্ধ পদ্মপাণিরূপে পরিচিত ছিলেন। অর্থাত্ পদ্মই ছিল তাঁর পুজোর প্রতীক। যে বাংলার কথা আলোচনা করছি সেটি মহাযানী বাংলা। ৮০০ থেকে ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ। পাল রাজত্ব বা তার কিছু আগেও হতে পারে। জয়দেব বা ক্ষেমেন্দ্রর কালে প্রচলিত
ধারার উত্পত্তি হলেও পাল রাজাদের আগেও এই দশাবতার তাস খেলার প্রচলন ছিল।
হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী মশাইএর বোদ্ধিক কাজের প্রায় প্রতিটি অংশে বৌদ্ধবাইএর ছোঁয়া ছিল, বলছেন বিনয় ঘোষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রকাশন বিভাগ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষদ
শাস্ত্রীমশাইএর যে পাঁচ খণ্ডের রচনাবলী প্রকাশ করেছে, তার ছত্রেছত্রে এই তত্বের প্রকাশ ঘটেছে।
আর
দশাবতার তাস খেলা, অঙ্কণরীতি, মুদ্রা, তাস তৈরি পদ্ধতি, রং
করার পদ্ধতির গবেষণায়
পাল যুগেরই কথা মনে আসে। এদের ঐতিহ্য আজও গর্বিতভাবে বহন করে চলেছেন যুবক
শীতল ফৌজদার। এ নিয়ে বিশদ কাহিনী রচনা হয়ত করা যায়,
কিন্তু আজ এখানেই ইতি।
(এই লেখাটি তৈরি হয়েছে, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর রচনাবলী, বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থ আর বিষ্ণুপুরের দশাবতার শিল্পী পরিবারের সদস্য শীতল ফৌজদারের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী)
No comments:
Post a Comment