প্রকৃতি বীরভূমকে অনেক দিয়েছিল। উন্নয়নের উত্তেজনায়
আরও অনেক কিছু আদায় করতে গিয়ে সেই প্রকৃতিকে বিপন্ন করেছে মানুষ। এখন নদী অগভীর হয়েছে, তার বয়ে আনা বালিতে চাপা পড়ে যায় ধান খেত।
জয়া মিত্র
২০০৪ সালে প্রথম যখন মল্লারপুরের
গড়িয়া গ্রামে যাই, ঘরমোড়া কাঁদরের ওপরের কালভার্ট থেকে নদীর বুক ছিল প্রায় দেড় মিটার নীচে। এই সব ছোট ছোট জলধারাকে কাঁদরই বলে বীরভূমে। আর বলে জোড়। অধুনা মাসাঞ্জোর তো আসলে মশান জোড়-ই। শ্মশান-লাগোয়া ছোট কোনও জলধারা, যে কিনা ময়ূরাক্ষীতে
এসে পড়ত। ময়ূরাক্ষীই
বা কীসে! পুরনো কাগজপত্রে ইস্তক গেজেটিয়ারে এখনও নাম লেখা আছে ‘মর’ নদী। এলাকায় বসবাস করা সাঁওতালরা নদীর আয়তন দেখে বুঝি কোনও ভরা-বর্ষার দিনের নাম দিয়েছিলেন ‘মর’। তাদের হড় ভাষায় ওই শব্দের মানে বড় নদী। ‘মর’ থেকে ‘মোর’ হয়ে শেষমেশ স্বচ্ছতোয়া নদী নাম নিল ময়ূরাক্ষী।
সে মর হল বড় নদী। মাঝারি নদীই কি কম? অজয়, ব্রাহ্মণী, কোপাই, বক্রেশ্বর, দ্বারকা, হিংলো, বাঁশলই বীরভূমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত জোড়া নদীনামের মালা। এঁরা হলেন সব রেজিস্ট্রি
খাতায় নাম লেখানো নদী। আপাত রুক্ষ এই লালমাটির দেশে এত এত মাঝারি ছোট-মাঝারি নদীই বা এল কোথা থেকে? কর্ণের জন্মপরিচয়
নিয়ে বিদ্রুপরত অর্জুনকে ভর্ৎসনা করতে গিয়ে এ প্রশ্নের খানিক হদিশ দিয়েছিলেন
যুবরাজ দুর্যোধন ‘সন্ন্যাসীর
কুল আর নদীর জন্মস্থান কেউ জানে না’। বীরভূম তল্লাটে কোনও তুষারশিখর নেই, হ্রদ নেই, নেই প্রকাণ্ড কোনও জলপ্রপাত। কোথা থেকে আসে এত নদীর জল?
হতে পারে যে, এ জল আসে মাটি থেকে? হতেও পারে হয়তো। বৃষ্টি তো তেমন কম নয় বীরভূমে, ঝরে পড়া জল নিজের নিয়মেই ঢালু দিকে চলে। বীরভূমে এই ঢালু দিকগুলি বড় সুন্দর। ঢেউ খেলানো উঁচু-নিচু কাঁকুরে মাঠ শুয়ে আছে গ্রানাইট আর ব্যাসল্ট পাথরে পিঠ রেখে। সছিদ্র কাঁকুরে সেই ঝুরো ল্যাটেরাইট
মাটির ঠিক নীচে, শক্ত শিলাস্তরের
ওপরে জমা হচ্ছে ঝরে পড়া সেই বৃষ্টির জলের ভাণ্ডার। বাকিটা গড়িয়ে গড়িয়ে আসছে এ পাশ ও পাশ হয়ে, নিচু জায়গা দিয়ে। চলতে চলতে সে জল আর একটু গভীর করে নিচ্ছে নিজের চলার পথ। ঝুরো মাটির মাঠ বেয়ে এ রকম অসংখ্য ছোট ছোট ধারা নামে বৃষ্টির পরই। দৌড়ে চলে লালমাটির কণা-কণা ভাসানো লাল জল। নিচু পথ যত গভীর হয়, উঁচু এলাকাগুলো রয়ে যায় অনড়, সুরক্ষিত।
হড় ভাষায় ‘বির্’ অর্থ জঙ্গল। সে নাম সার্থক করে শাল-মহুয়া-নিম-পড়াসি হাজার গাছের নীচে নীচে ঝোপঝাড়ের ঘন জঙ্গল। লতার আদিম বাঁধন। নানা রকমের ঘাস। মাটি পালিয়ে যায় তার সাধ্য কী। সেই মাটিকে দেখি আরও মাইক্রো লেভেলে বৃষ্টির আহ্লাদে আরও ছোট ছোট উঁচু-নিচু তৈরি করে চলছে আরও ছোট ছোট জলের ধারা, যেন পিঁপড়ে মাপের নদী। আর সেই সব জলের ধারা, যেখানে অনেক ক’জন মেলে, নিচু জায়গার মাটি ভাসিয়ে নেয়, সেখানে তৈরি হত খোয়াই। যেখানে জমি অত নিচু নয়, কিছু সমতল, কিছু তৃণাচ্ছাদিত,
সে রকম জায়গায় এক একটি জমিতে নীচ থেকে জল বেরিয়ে আসছে। বক্রেশ্বরের মাটি ফেটে ওঠা গন্ধক গন্ধ প্রস্রবণের মতো নয়, বরং সদ্য কথা বলতে শেখা কচির আপন মনে বিড়বিড় করার মতো সামান্য চেহারায়। কিছুটা মাটি একটু কাদা-কাদা, গড়িয়ে আসছে নিতান্ত ক্ষীণ একটি ধারা। দেখে কোনও মতে বিশ্বাস হয় না এ পাঁচ হাতের চেয়ে বেশি দূর যাবে। কিন্তু সেই পাঁচ হাত, আট হাত চলতে চলতে দুর্জয় অশ্বত্থ চারার মতোই যত সামনে যাবে, বড় হতে থাকবে একটু একটু করে।
এই জন্মঘরই কাঁদর। কেবল বীরভূম নয়, এ রকমই জন্মঘর পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমানের অনেক নদীর। যাদের গায়ে ঝুরো মাটি আর তার নীচে পাথর, মাটির নীচে লুকিয়ে পড়া জলকে যা পাতালে চলে যেতে দেয় না, উপরিতলের কাছাকাছিই ধরে রাখে। সব কাঁদর কাঁসাই, বরাকর, অজয় বা কোপাই হয় না। ম্যাপ মেললে দেখা যায়, এ সব নদীর প্রত্যেকের
আশপাশে জালের মতো অসংখ্য ছোট ছোট গড়িয়ে আসা জলধারার ছবি আঁকা আছে। ওই মাটি, পাথর, জল আর গাছপালায় মিলে এমনই ছিল এই লালমাটি অঞ্চলের রূপসংস্থান।
গাঙ্গেয় পলিমাটির স্তরীয় মসৃণতা থেকে ভিন্ন, রূপে স্বভাবে।
No comments:
Post a Comment