হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের, কলিকাতা সেকালের একালের থেকে
হ্যামিলটন বর্ণিত
কোম্পানি কুঠী ও দুর্গ সুতালুটীর অন্তর্গত ছিল। খৃঃ ১৮২০ অব্দে ইহা ভাঙ্গিয়া ফেলা
হয়। খৃষ্টীয় ১৭০০ অব্দের ২৭ মার্চ্চ পর্য্যন্ত যে সমস্ত পত্রাদি এদেশ হইতে কোম্পানী
বাহাদুরের কর্ম্মচারীরা বিলাতে পাঠাইয়াছিলেন, তাহা সুতালুটী হইতে প্রেরিত বলিয়া
ব্যক্ত আছে। ইহার পরের সমস্ত চিঠি পত্র যথাক্রমে কলিকাতা ও ফোর্ট উইলিয়াম হইতে
প্রেরিত(Yule’s Glossery(See Chutanutty))।
এই প্রাচীন ফোর্ট
উইলিয়াম দুর্গের কিছু দক্ষিনে, একটী নদী বা খাল ছিল। ঐ খাল বর্ত্তমান ওয়েলিংটন
স্কোয়ারের নিকট হইতে আরম্ভ হইয়া, চাঁদপাল ঘাটে গঙ্গার সহিত মিলিত হইয়াছিল। ১৭৯৩
খৃঃঅব্দে অপজনের ম্যাপেও ইহার উল্লেখ আছে। কিন্তু এখন ইহার কোন অস্ত্বিত্ব নাই(এই
খালের বা Creek(ক্রীকের) কোন চিহ্ন না
থাকিলেও, ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পার্শ্ববর্ত্তী – ‘ক্রিক রো’ ইহার নাম রক্ষা করিতেছে।
‘ডিঙ্গাভাঙ্গা’ নামের সহিত এই খালের কোন সম্বন্ধ আছে কি না পাঠক তাহা অনুমান করিয়া
লইবেন। হলওয়েল সাহেব – গোবিন্দপুরের দক্ষিণ সীমার খালের সম্বন্ধে
লিখিয়াছেন – On my joining the Fleet at Fulia, I did hear he was sent to
Gobindapur Creek to burn & destroy the great boats there, that they might
not be employed by the enemy in the attack or persuit of the sheeps. Holwell’s
Indian Tracts, 1764, p 238)। এই খাল গোবিন্দপুর ও কলিকাতা এবং
সুতালুটী গ্রামের অন্তর্বর্তী সীমা ছিল। যখন গোবিন্দপুরের দক্ষিণ সীমার খাল –
‘গোবিন্দপুর খাত’ বলিয়া উল্লিখিত হইত, তখন উত্তরের এই খালটীর সম্ভবতঃ এরূপ কোন
একটা নাম থাকিতে পারে। কিন্তু সে নাম যে কি ছিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে পারা যায়
না।
সুতালুটী, সম্ভবতঃ
শেঠ ও বসাকদের আগমনের পর হইতে, খ্যাতিলাভ করিয়াছে। কিন্তু তাঁহার পুর্ব্বে কলিকাতা
গ্রামের একটা নাম ঘোষণা হইয়াছিল। চণ্ডীকাব্য হইতে পাঠক দেখিলেন, অগ্রে ধনন্তগ্রাম
পরে কলিকাতা, এই ভাবেই নির্দ্দেশ আছে। কলিকাতার অধস্তনকালের আখ্যা সুতালুটীর
চণ্ডীকাব্যে নাই।
চণ্ডীকাব্য রচনার পর
হইতে সুতালুটীর ঐরূপ আখ্যা হইয়াছে। গ্লাডউইনের ‘আইন-আকবরীতে’ ‘ওয়াশীল তুমারজামার’
মধ্যস্থ তালিকায় এই কলিকাতাই উল্লিখিত আছে। ১৫৮২ অব্দে রাজা টোডরমল্ল সমস্ত
বঙ্গদেশ জরিপ করিয়া এই তালিকা প্রস্তুত করেন। আইন-আকবরীতে ১৫৯৬ অব্দে শেষ হইইয়াছে।
বসুকদিগের সুতালুটী-হাট পত্তনের ন্যুনতম শত বৎসরের পরে,
অর্থাৎ খ্রীষ্টীয় ১৬৬০ অব্দে ভ্যান্ডেন ব্রুক (Vanden
Broock) নামক জনৈক ওলান্দাজ, ততসাময়িক একখানি মানচিত্র প্রকাশ
করিয়াছিলেন। তাহাতে (Soclanotti) বলিয়া একটী গ্রামের
নামল্লেখ আছে(অনেকেই অনুমান করেন, বসাকেরাই তন্তুবায়ের কাজ করিতেন, বস্ত্র ও সূতা
প্রস্তুত করিতেন। কিন্তু ‘বসুক’ নামক জাতিতে-বিচার গ্রন্থপ্রণেতা মদনমোহন বাবু
বলেন – ‘বসুকেরা তন্তুবায়দিগের নিকট বস্ত্রবয়ন করাইয়া লইতেন। এই নিম্নশ্রেণীস্থ
বয়নজীবিগণ’ বসুকদের নিকট কার্পাস গ্রহণ করিত এবং চরকায় সূতা কাটার জন্য তুলার পাঁজ
প্রস্তুত করিত। এই সমস্ত তুলা বসুক বা বসাকদের নিকট গৃহীত হইত এবং চরকায় সূতা
কাটিবার জন্য ব্যবহৃত হইত। পরে আবার সূত্র বা বস্ত্রাকারে তাহাদিগকেই প্রদত্ত হইত।
এই আদান ক্রিয়ার অবান্তর সম্বন্ধ বশতঃ ঐ সকল তুলার পাঁজ ‘বসুক বা বোসকে’ নামে আখ্যাত।
যে সকল স্ত্রীলোক কাটনা কাটিতেন, তাহাদিগকে ‘কর্ত্তনী’ বলিত। ‘কাটনা’ শব্দ কর্ত্তনীর
অপভ্রংশ। এখনও পর্য্যন্ত কাটনা শব্দ বঙ্গদেশ হইতে লোপ পায়নাই – এবং অনেক সুদূর
মফঃস্বলে কাটনা-কাটার প্রথা – বৃদ্ধা বিধবাদের মধ্যে এখনও প্রচলিত আছে। বঙ্গদেশে
একটী প্রবাদই আছে – ‘কাটনা কাটনা ধন’।’)। এই সময় কলিকাতার মধ্যে সূতার ও
সুতার-লুটীর বাণিজ্য ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাইতেছিল।
No comments:
Post a Comment