সেকালে বাঙ্গলার
সূক্ষ্ম-সূত্র-শিল্প, এক অপুর্ব্ব জিনিষ ছিল। ‘ঢাকাই মসলিন’ বঙ্গের অতীত গৌরবের
সামগ্রী। ইউরোপের অনেক সাম্রাজ্ঞী, ভারতের মোগল বাদসাহদিগের পাটরানীগণ, বেগমগণ, এই
ঢাকাই-মসলিন নির্ম্মিত পোষাক পরিবার জন্য উদগ্রীব হইয়া থাকিতেন। ঢাকার দশবার ক্রশ
উত্তর পূর্ব্বে, ডুমরাও নামক একটী স্থান, অতীতকালের এইরূপ সূক্ষ্ম-সূত্র-শিল্পের
জন্য বিখ্যাত ছিল। এখনও সেখানে অনেক তন্তুবায়ের বাস আছে। এখনও একটী প্রবাদ আছে –
যে এই স্থানের সুপ্রসিদ্ধ কর্ত্তনীরা এক রতি ওজনের তুলায় একশত পঁচাত্তর হাত সূতা
কাটিয়া দেন।
পাঠক! বঙ্গের এই
প্রাচীন গৌরবের অস্তমিত অবস্থায়, হয়ত এ কথা বিশ্বাস না করিতে পারেন। কিন্তু
তাঁহাদের বিশ্বাসের জন্য, আমরা প্রসিদ্ধ ফরাসীবণিক – টাভারনিয়ারের উক্তি, নিম্নস্থ
পাদ-টীকায় উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি(The broad BAFTAS are 1¾ cubit wide and
the piece is 20 cubits long. They are commonly sold from 5 to 12 MAHAMUDIS, but
the merchant on the spot is able to have them made much wider and finer and up
to the value of 500 MUHAMUDIS the piece. In my time, I have seen 2 pieces of
them sold for each of which 1000 MUHMUDIS were each 28 cubit. Mahamed Ali Beg
while returning to Persia from his embassy to India presented CHASUFI(11) with
a Cocoanut of a size of an ostrich’s egg. Enriched with precious stones and
when it was opened a turban was drawn from it 60 cubits in length and of a
MUSLIN so fine, that ypou would, scarcely know what it was that you had in your
hand. The Queen Dowager with many of the Ladies of the Court was surprised at
seeing a thread so delicate which almost escaped the view – Travels of
Tavarnier(1679) vol ii p 7-8) তাঁর সারমর্ম্ম এই – ‘বাপতাগুলি
পৌণে দুই হাত চওড়া ছিল। একটী থানে কুড়ি হাত কাপড় থাকিত। এই কাপড়্গুলি, ৫ হইতে ১২
মামুদিতে সাধারণতঃ বিক্রয় হইত। যদি কেহ ফরমাস করিতেন, তাহা হইলে তদ্দারা তাঁহারা
আরও চওড়া ও সূক্ষ্ম বস্ত্র প্রস্তুত করিয়া দিত। তাঁহার দাম ৫০০ মামুদী পর্য্যন্ত
হইত। আমাদের সময়ে আমি দেখিয়াছি, এক হাজার মামুদীতে দুই খন্ড কাপড় বিক্রয় হইয়াছে।
ইংরাজ সউদাগরগণ অপরটী লয়েন। এ কাপড়্গুলি লম্বে ২৮ হাত। মহম্মদ আলিবেগ ভারতবর্ষ
হইতে পারস্যে ফিরিয়া জাইবার সময়, অষ্ট্রীচ ডিমাবাকার, এক ক্ষুদ্র রত্নখচিত নারিকেল
খোলের মধ্যে এক খণ্ড মসলিন লইয়া যান। পারস্য-সম্রাট’ দ্বিতীয় শাহ্ সুফিকে, এই
অপুর্ব্ব জিনিস উপহার দেওয়াই তাঁহার উদ্দেশ্য। এই রত্নখচিত নারিকেলের খোলের মুখ
খুলিবার তন্মধ্য হইতে ৬০ হাত লম্বা এক মসলিনের পাগড়ী বাহির হইল। এক মসলিন এত
সুক্ষ্ম সুত্রে প্রস্তুত, যে আদৌ তাঁহার অস্ত্বিত্ব অনুভব করা যায় না, যত লম্বা
মসলিন হউক না কেন – তাহার ভার অতি কম। ভরি ও রতি ইহার মাপ পরিমাণ। আমরা গল্প
শুনিয়াছি, যে ঢাকাই মসলিনের একখণ্ড যদি রাত্রিকালে কোন তৃণক্ষেত্রে রাখিয়া দেওয়া
যায়, তাহা হইলে সমস্ত রাত্রি শিশিরে ভিজিয়া, তাঁহার এরূপ অবস্থা হয়, যে পরদিন
প্রভাতে – সূর্য্য উঠিলেও তাঁহার অস্ত্বিত্ব বোধ হয় না। বোধ হয়, যেন ঘাসের উপর
একখানি মাকড়সার সুদীর্ঘ জাল বিছান আছে।’
বঙ্গের সেকালের
সূক্ষ্ম-কার্পাসসূত্র – বাঙ্গালীর ভাগ্যলক্ষ্মী ছিল। অনেক টাকার সুক্ষ্মসূত্র,
কার্পাসবস্ত্র ও মসলিন এ দেশ হইতে ইউরোপের হাটে উচ্চমুল্যে বিক্রয় হইত। কাটনা-কাটা
এদেশে তখনকার একটা সাধারণ প্রথা। মোগলদিগের আমলে – এই কাটনা-কাটা প্রথার প্রচলন
ছিল। কবিকঙ্কণের নিম্নলিখিত শ্লোকটী তাঁহার প্রমাণ – প্রভুর দোসর নাই, উপায় কে
করে/ কাটনার কড়ি কত যোগাব ওঝারে।/ ‘দাদনি’ দেয় এবে মহাজন সবে/ টুটিল সূতার কড়ি
উপায় কি হবে?/ দুপণ কড়ির সূতা একপণ বলে/ এক দুঃখ লিখেছিলা অভাগির কপালে!
তখন স্ত্রীলোকেরা দাদনী লইয়া কাটনা কাটিতেন। শেঠ-বসাকেরা
পরবর্ত্তী কালে দাদন দিয়া কাজ করাইতেন, পরে ইংরাজ-বণিকেরাও ‘দাদনী’ প্রথা অবলম্বন
করিয়াছিলেন।
No comments:
Post a Comment