হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের, কলিকাতা সেকালের একালের থেকে
বসাক বা বসুকদিগের আদি বাসস্থান আদিসপ্তগ্রাম।
সপ্তগ্রামের একটী পুষ্করণী তাহাদের নামানুসারে ‘বসকা-দিঘী’ বলিয়া বিখ্যাত।
সপ্তগ্রামের বাসকালে বসাকদিগের ‘বসক’ উপাধি ছিল। কলিকাতায় আসিবার পর তাহা ‘বসাকে’
পরিবর্ত্তিত হয়।(‘বসুক’ গ্রন্থ প্রণেতা মদনমোহন হালদার মহাশয় বলেন – ‘বসুক’ শব্দই
বসাকদের প্রকৃত উপাধি এবং বসুকেরা বৈশ্য শ্রেণীভুক্ত। একখানি সারগর্ভ গ্রন্থ
লিখিয়া তিনি ইহা প্রতিপন্ন করিয়াছেন। বসুক হইতে বসাক শব্দে দাঁড়াইয়াছে। বসুক
শব্দের অর্থ ধনসম্পত্তি – ভাবার্থ – কর ও রাজস্ব। উহা বৈশ্যের বর্নগত উপাধি। আমরা
এই গ্রন্থে চিরপ্রচলিত বসাক শব্দই ব্যবহার করিব। ইহা না হইলে পাঠকেরা গোলে পড়িতে
পারেন।)
এই বসাকদের আবার
শ্রেষ্ঠী বা শেঠ বলিয়া এক সম্প্রদায় আছেন। শেঠেরাও এই সময়ে সপ্তগ্রাম হইতে আসিয়া
কলিকাতায় বাস আরম্ভ করেন।
সেকালের কলিকাতা
দুইখানি গ্রামে বিভক্ত ছিল বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে।
কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে
আছে-
ত্বরায় চলিল তরী
তিলেক না রয়/ চিৎপুর শালিখা সে এড়াইয়া যায়।/কলিকাতা এড়াইল বেণিয়ার বালা/বেতোড়েতে
উত্তরিল অবসান বেলা।/ বেতাই-চন্ডিকা পূজা কৈল সাবধানে/ধনন্তগ্রাম খানা সাধু এড়াইল
বামে।/ ডাইনে এড়াইয়া জ্যায় হিজলির পথ/ রাজহংস কিনিয়া লইল পারাবত।/ কালীঘাট এড়াইল
বেনিয়ার বালা/ কালীঘাটে গেল ডিঙ্গা অবসান বেলা।/ মহাকালীর চরণ পূজেন সওদাগর/ তাহার
মেলান বেয়ে জ্যায় মাই নগর।
শ্রীমন্ত সওদাগর কলিকাতা, উত্তীর্ণ হইয়া ধনন্তগ্রাম
প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, কবির বর্ণনানুসারে, এই ধনন্তগ্রাম সেকালের গোবিন্দপুর বলিয়া
বোধ হয়। শ্রীমন্ত, পরপারস্থ বেতাই-চণ্ডীকার(বেতড়া বা বেতোড় আধুনিক ব্যাঁটরা। উহা
হাবড়া ষ্টেশন হইতে এক মাইল পশ্চিমে। বেতোড়া খালকে বেতাড়ির খাল বলে। উহার মোহানা
আদিগঙ্গার মোহানার ঠিক সম্মুখে। পুর্ব্বে পর্টুগীজ বণিকেরা ঐ খাল দিয়া সপ্তগ্রামে
যাতায়াত করিতেন। বেতাই-চণ্ডীর পূজা উপলক্ষে, সেই স্থানে অতীতকালে এক মহামেলা
অনুষ্ঠিত হইত। ফ্রেডরিক সিজার নামক পুর্ব্বোক্ত সমসাময়িক ভ্রমণকারী ১৫৭০ খৃঃ অব্দে
বাঙ্গালায় আসেন। তিনি বেতকীর খালে চড়া পড়িতে দেখিয়া গিয়াছিলেন। তৎপরে মুকুন্দরামের
সময়ে ঐ খাল একেবারেই বন্ধ হইয়া যায়। বেতকীর খাল বন্ধ হইলে, ইংরাজ ও পর্টুগীজ
বণিকেরা হুগলী যাতায়াতকালে ভাগীরথী দিয়া যাইতেন। তখন সপ্তগ্রাম হইতে আসিবার সময়
গরিফা, গোন্দলপাড়া, ইছাপুর, মাহেশ, খড়দা, কোন্নগর, চিৎপুর, শালিখা, প্রভৃতি
গ্রামগুলি অতিক্রম করিয়া কলিকাতা ও গোবিন্দপুরের সম্মুখ দিয়া আদিগঙ্গায় প্রবেশ
করিতে হইত। ফ্রেডরিক লিখিয়াছেন – Buttor
a good tides rowing before you come to Satgaw from thence upwards the ships do
not go because the river is very shaloiw. The small ships go to Satgaw and
there they trade.) পূজা করিয়া আদ্যগঙ্গায় প্রবেশ কালে, ধনন্তগ্রাম
খানি বামদিকে দেখিয়াছিলেন। ‘ধনন্ত’ শব্দ ‘ধনস্থের’ অপভ্রংশ। ধনস্থ শব্দের সঙ্গত
অর্থ – যে গ্রামে ধন আছে বা ধনীগণ বাস করেন। বসাকেরা চন্ডীকাব্য রচনার পুর্ব্বে,
সপ্তগ্রাম হইতে আসিয়া গোবিন্দপুরে বাস করেন। তাঁহারা যে এই গ্রামের আদিম অধিবাসী
তাঁহার আর কোনও সন্দেহ নাই। তাহাদের পরই, কালীঘাটের হালদার মহাশয়গণের পুর্ব্বপুরুষগণ
ও কলিকাতা ঠাকুরগোষ্ঠীর পূর্ব্বপুরুষ, বহু পরে গোবন্দপুরে আসিয়া বাস করেন। কাপ্তেন
আলেকজান্ডার হ্যামিল্টন ১৭০৬ খৃঃ অব্দে অর্থাৎ জব চার্ণক কর্ত্তৃক কলিকাতা
স্থাপনের ষোল বৎসর পরে গোবিন্দপুরে আসেন। তাঁহার লিখিত বিবরণে প্রকাশ, যে
গোবিন্দপুর ফোর্ট উইলিয়াম-দুর্গের দক্ষিনে(হ্যামিল্টন, কলিকাতার পুরাতন
কেল্লা,(অর্থাৎ বর্ত্তমান জেনেরেল পোষ্টাফিস, কষ্টম হাউস ও ই, আই, রেলওয়ে এজেন্ট
আফিসের অধিকৃত স্থানে যে কেল্লা ছিল, যাহার অবস্থান ছিল লর্ড কার্জ্জন বাহাদুর –
পিত্তলের লাইন দিয়া চিহ্নিত করিয়া দিয়াছেন, যাহা নবাব সিজাউদ্দৌলা আক্রমণ করেন)
তাঁহার কথাই বলিয়াছেন। পুরাতন দুর্গের অস্ত্বিত্বমাত্র এখন নাই। পাঠক যেন এই
পুরাতন ফোর্ট উইলিয়ামকে গড়ের মাঠের বর্ত্তমান কেল্লা বলিয়া না ভাবেন) এবং গোবিন্দপুরের
দক্ষিন সীমা হইতে ঐ দুর্গ তিন মাইল উত্তরে। ১৬৯৬ খৃঃ এই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্ম্মান
সুচনা হয়।
No comments:
Post a Comment