স্বাধীণতার পর গ্রামীণ
সমাজবদ্ধ মানুষদের ইংরেজি পড়াতে, ইওরোপের ধাঁচে শিল্প পরিকাঠামোয় যোগ্য করে
তুলতে, নতুন উত্পাদনব্যবস্থায় টেনে আনতে রাষ্ট্রব্যবস্থার অর্বুদ পরিমান অর্থ
ব্যয়িত হচ্ছে। কিন্তু সাদাচোখে দেখা যাচ্ছে, কাজের কাজ খুব একটা কিছু
হচ্ছে না। এই কাজে গ্রামীণ মানুষের অংশগ্রহণই নেই। বিশাল
সংখ্যক এই মানুষেরা যে সমাজে বাস করতেন, সেই সমাজকে বলপূর্বক ভেঙে দেওয়া হয়েছে
মধ্যবিত্ত পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থার নানান পরিকাঠামো ব্যবহার করে। ইংরেজদের
নীতি অনুসরণ করতেগিয়ে প্রশাসনে এবং পাইকারি ব্যবসার বড় অংশে উচ্চবেতনের চাকরি
দখলকরে রাখা মধ্যবিত্তরাই আজও কেন্দ্রিকৃত দর্শণে বিশ্বাসী এবং আজও তৃণমূলস্তরে
সেই নীতিই প্রয়োগ করে চলেছেন। পশ্চিমি নানান দর্শণের প্রভাবে আজও
তারা চেষ্টা করে চলেছেন সেই শহুরে পাইকারি ব্যবসা পরিকাঠামোর গ্ল্যামার বৃত্তান্ত
প্রচারের। তৃণমূলস্তরের ব্যবসার মূলগত প্রকৃতিই হল অকেন্দ্রীকৃত
ব্যবসার নীতি যা আদতে চোখে পড়ে না। এই ব্যবসা কেন্দ্রিকৃত শক্তির পক্ষে
চিরকাল দখল রাখাও কঠিন। সেই ব্যবসায় আঘাত করেও অতীতের অভিজ্ঞতায়দেখা গিয়েছে, সামরিক
কেন্দ্রিভূত দৃঢ়তায় সাময়িক সাফল্য পাওয়া গেলেও, এক সময়ে সেই সফল্য কর্পুরেরমত উবে
গিয়েছে। বাঙলায় অন্ততঃ তৃণমূস্তরে ব্যবসা দখলের ইংরেজি সাফল্য
খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন সনাতন
সমবায়ী সমাজের বিকেন্দ্রভূত দর্শণকে তাঁদের ব্যবসার মাধ্যমে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য
করেছেন তৃণমূলস্তরের পথ ব্যবসায়ীরা। পথ ব্যবসায়ীরা ছিলেন বলেই ভারত
সমাজের ছোট ছোট উত্পাদকেরা, লুঠেরা ইংরেজদের সময়েও তাদের উত্পাদিত নানান দ্রব্য
স্থানীয় অথবা আঞ্চলিক বাজারে এমনকী ব্যক্তিমানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছনোর কাজ করতে
পারতেন। বৌদ্ধ আমলের সৃষ্টি জাতকের সেরিবা সেরিবানের গল্প আমরা
অনেকেই জানি। এঁরা মাথার ঝাঁকা নিয়ে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতেন স্থানীয়
উত্পন্ন দ্রব্য বিক্রি করতে। এ ছাড়াও পঞ্চতন্ত্র অথবা নানান
অতীতের সাহিত্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের উত্পন্ন দ্রব্য বিভিন্ন এলাকায় পাওয়া
যাওয়ার উল্লেখ রয়েছে। এই কাজগুলিও করতেন এই পথ ব্যবসায়ীরা। যেহেতু
পাইকারদের সঙ্গে দামদস্তুর করা বেশ ঝামেলার কাজ ছিল, সেহেতু এই ধরণের তৃণমূলস্তরের
ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই অনেক শিল্পী সমাজই বেঁচে থাকতেন, নিজেরদের আবিষ্কারকে
বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন, আবার কেউ কেউ উত্পাদনের সঙ্গে ব্যবসাও করতেন সমান তালে। এই দুই
পরস্পরেরপ্রতি নির্ভরশীল গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজ দার্শণিকভাবেও পরস্পরের সঙ্গে টান অনুভব
করতেন।
পূর্ব মেদিনীপুরের চন্দনপুরের কাঁসার নানান দ্রব্য যারা
তৈরি করেন, তাঁরা লেখকদের জানিয়েছিলেন, সুদূর অতীত থেকেই পাইকারদের তাঁরা ধারে
পণ্যদ্রব্য বেচতেন ঠিকই, কিন্তু সেই ব্যবসা এই গ্রামীণ উত্পাদকদের পক্ষে খুব
সুখপ্রদ হত না। পাইকারদের পাশাপাশি
ছিলেন নানান খুচরো বিক্রেতা, যারা প্রাথমিকভাবে ধারে এই বিচিত্র ধরণের উত্পাদিত
দ্রব্য ঝাঁকায় নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন বৃহত বাঙলার নানান অঞ্চলে – ওড়িশা, বিহার(এখন কিছুটা ঝাড়খন্ড), অসম রাজ্যের গাঁয়ে গাঁয়ে। সেখানে সহজেই গ্রমীণদের কাছে বিক্রি করতেন এইসব কাঁসার
দ্রব্য। তাঁরা বিক্রি করে এনে
দাম মেটাতেন নানান উপায়ে – কখোনো অর্থ, কখোনোবা পণ্যে। তৃণমূলস্তরের খুচরো ব্যবসায়ীরাই ভারতের নানান খোলা
বাজারে সাধারণ গৃহস্থ, ছোট ব্যবসায়ীদের নানান নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য বিক্রি করতেন
বিভিন্ন হাট, মেলা, উত্সব, পরব, পুজোসহ নানান মানব সংমিলনে। আজও আমরা দেখি বিভিন্ন পারম্পরিক মেলা, উত্সবে সারা
ভারত থেকেই নানান পারম্পরিক ব্যবসায়ী বিভিন্ন এলাকার উত্পাদিত দ্রব্য নিয়ে এসে
বিক্রি করছেন। এই প্রচেষ্টাটি
কিন্তু অতীতেও ছিল। বাণভট্টের হর্ষচরিতে
উজ্জয়ণীর হোলি উত্সবের সাড়ম্বর বর্ণনায় পথ পাশের দেকানগুলির বর্ণনা যেমন পাওয়া
যাচ্ছে, তেমনি পরোক্ষে অস্থায়ী নানান দেকানদারদের কথাও তিনি উল্লেখ করছেন। পারস্পরিক একটি নির্ভরতাবোধও ছিল সমমাজের নানান সেবা
প্রদাণকারী এবং উত্পাদক-তৃণমূলস্তরের পণ্য বিক্রেতাদের মধ্যে। আজ মধ্যবিত্ত আমলারা এয়
উদ্যম উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধংস করে দিয়েছেন বড় পুঁজির স্বার্থে। নিরক্ষর ঝাঁকাওয়ালাদের কাগজপত্রদেখতে চাওয়া হয়, হিসেব
চাওয়া হয়, নানানভাবে হেনস্থাও করা হয়। কাগজ না থাকলেই
জরিমানা। মুখে
বর্ণিত ইতিহাসের চর্চা করি পশ্চিমের দেখাদেখি, ঐ টুকুই। সে যে গবেষণা।
বাস্তবে কাগজ না থাকলে সবই মিথ্যে। ফেরিওয়ালারা বলেন
ভিক্ষে চাই না মা, কুকুর সামলাও। নিজের দেশে যেন
নিজেরাই পরদেশি।
No comments:
Post a Comment