হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় বণিক কিন্তু সেই পণ্যদ্রব্যগুলি
নিয়ে প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করে এসেছে বিশ্ববাজারজুড়ে। কিন্তু সেই
একচেটিয়া বাজার বাড়াতে, বিশ্ব বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে এনে, প্রাকৃতিক
সম্পদকে নিংড়ে অতিরিক্ততম উতপাদনকরে, নিজের দেশের, সাম্রাজ্যভুক্ত দেশের
উত্পাদকদের উতপাদনক্ষমতা শেষপর্যন্ত ব্যবহার করার অধিকার দেয় নি ভারতীয় সমাজ। এবং ভারতীয়
বণিকেরাও, সে তৃণমূলস্তরেরই বণিকই হোক অথবা পাইকারি বিশ্ববাজারের বণিকই হোক, সেই
নিয়ন্ত্রণ মেনে ভারতে এবং বিশ্ব বাজারে ব্যবসা করে এসেছে। এই সামাজিক
শৃঙ্খল ছিঁড়ে গেল ইংরেজের ভারত তথা বাঙলা দখলের মধ্যে দিয়ে। কয়েক স্তবক
আগেই আমরা দেখেছি বিকেন্দ্রিকৃত ভারতীয় সভ্যতার নানান রেণুকে ভাঙতে ইংরেজ আর
ইংরেজদের স্নেহধণ্য ব্যবসায়ীরা এক যোগে বংলার সমাজ সংগঠণের ওপর বিশাল একটা
অত্যাচার নামিয়ে এনেছিল। বিপরীতভাবে আমরা দেখেছি সেই অত্যাচারী লুঠেরা সময়
পেরিয়ে আজও ভারতীয় অর্থনীতিতে পথ ব্যবসায়ীরা তাদের চিরাচরিত সামাজিক-ব্যবসায়িক
জ্ঞাণ প্রয়োগ করে বিশ্বায়ণের ব্যবপারীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তৈরি করার চেষ্টা করছেন
ভারতবর্ষের চিরাচরিত দর্শণ, যে দর্শণের মূল লক্ষ্য সবাইকে নিয়ে সমানতালে সমভাবে
বাঁচা।
স্বাধীণোত্তর ভারতের প্রচলিত
রাষ্ট্রিক অর্থনীতি যে ভাষ্যই পেশ করুক না কেন, প্রথাগত ভারতীয় সমাজে তৃণমূলস্তরের
উত্পাদক এবং ব্যবসায়ীরা যে সামাজিক সুরক্ষার বলয়টির পরিবেশ অনুভব করতেন ইংরেজ
শাসনের পূর্বে, ইংরেজ আমল থেকে আর সেই পরিবেশ বর্তমান নেই। সনাতন
সমবায়ী সমাজের সামাজিক রীতিনীতি, সমাজবন্ধন বিলয় হয়ে যাওয়ার পর থেকেই বিগত আড়াইশ
বছর ধরে বহু উত্পাদক, ব্যবসায়ী তাঁদের বংশপরাম্পরিক ব্যবসা ছেড়ে কায়িক শ্রম থেকে
রোজগারের তুলনামূলকভাবে সহজ সোজা পথ ধরেছেন। পশ্চিমি জ্ঞাণচর্চা পদ্ধতিতে কায়িক
শ্রম অর্থে অদক্ষ অথবা অর্ধদক্ষ শ্রমিক- শ্রমিক দক্ষতা বিরোধী, ভারতীয় সামাজিক
সভ্যতা বিরোধী এই তত্ব প্রচারের কাজ যে লেখকেরা করছেন না সে কথা কম্বুকন্ঠে জনিয়ে
দেওয়া যাক। অস্বীকার করার উপায় নেই, ব্রিটিশ পূর্ব সময় পর্ষন্তু
ভারতীয় গ্রামীণ উত্পাদক, ব্যবসায়ীরা যে সামাজিক সুরক্ষার অদৃশ্য বলয়ে বাস করতেন,
ভারতের বহুগ্রামসমষ্টিতে সেই অবস্থাটি ভেঙে দিতে সক্ষম হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। তবু আজও
যতটুকু পাওয়া যায় সেইটুকু নিয়েই গ্রামীণ উত্পাদক এবং তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীরা
সমাজের তৃণমূলস্তরের মানুষদের নানান সামান্য চাহিদাটুকুও মিটিয়ে আসতে পেরেছেন।
দীনেশ সেন মশাইএর ভাষায় বিগত
একসহস্র বছর ধরে গৌড়বঙ্গের রাষ্ট্রিক-সামাজিক পরিবর্তন নিরন্তর ভাঙাগড়ার
মধ্যেদিয়ে চলেছে। প্রথমে আগ্রাসী মুসলিম সাম্রাজ্য, পরে ধংসাত্মক ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যের প্রতিঘাতে বাঙলার সমাজজীবনে এসেছে নানান পরিবর্তন। ইসলামের
সঙ্গে বাঙলার অভিঘাতি পারম্পরিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটেছে, অনেক অত্যাচারও ঘটেছে
ঠিকই- কিন্তু ইসলামের বড় একটি দিক ছিল, সে বাঙলা তথা ভারতের সম্পদ লুঠ করে যে
দেশগুলি থেকে ভারত আক্রমণ করতে এসেছিল, সেই সব দেশে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। প্রথম যুগে
লুঠেরা সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও, দীর্ঘ সময় ধরে ভারত তথা বাঙলার সংস্কৃতির সঙ্গে
মিলেমিশে বাস করে নতুন এক সংশ্লেষী সংস্কৃতির নমুনা স্থাপন করে গিয়েছে। যতটুকু
অত্যাচারী পরিবর্তন এসেছে, তা সমাজের বহিরঙ্গে, অন্তরে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা দেওয়া
নেওয়ার। পারম্পরিক সমাজের ভেতরে প্রবেশ করে নিজের কেন্দ্রীভূত
দর্শণ ভিত্তিকরে, সমাজকে ভেঙেচুরে নিজের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা
করে নি।
মুঘল শাসনের উত্তুঙ্গ সময়েই
ব্রিটিশ বণিক-শাসকেরা ভারতে পদার্পণ করেছেন। ভারতে পা রাখার অনেক আগে থেকেউই
সারা বিশ্বে অন্যান্য ইওরোপিয় শক্তিরমত ব্রিটিশরা যে ধংসাত্মক অত্যাচার চালিয়ে
এসেছিল, সেই কাজটি তারা অনেক আগেই ভারতের মাটিতে শুরু করতে চাইছিল, কিন্তু নানান
কারণে পারছিলন না। ১৭৭৫৭র পর থেকেই ভারতের শাসন ব্যবস্থায় তারা
মাথাগলিয়েদেওয়ার কাজটি করতে সক্ষম হল তারা। মুঘলদেরমত শুধুই শাসন করে তাদের আশ
মেটেনি, ব্রিটিশদের প্রথমথেকেই উদ্দেশ্য ছিল ইংলন্ডের বিকাশ, এবং ভারতবর্ষসহ
এশিয়ার আমূল ধংস প্রক্রিয়া। তাই যে কোনও মূল্যেই তারা চেষ্টা করেগিয়েছে, প্রথমে বাঙলা,
পরে ভারতের নানান স্থানের সম্পদ আহরণ করে, ভারতের বিকশিত প্রযুক্তি আর জ্ঞাণ দখল
করে, ভারতের শিল্পউত্পাদন ব্যবস্থাকে সমূলে ধংস করে, ভারতের চিরাচরিত
শিক্ষাব্যবস্থা ধংস করে এক বিকশিত সভ্যতা থেকে অধস্তন দেশ হিসেবে গড়ে তুলবে। তার জন্য
তার যা যা করণীয় ঠিক ততটুকু করতে পিছপা হয় নি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা। পলাশির পর
প্রথম ৭০ বছর লুঠতরাজি চালাবার পর ভারত এবং তার মধ্যবিত্তকে নিজেদের দর্শণে
পাখিপড়ারমতকরে গড়ে তুলেছে। ১৯০বছরের শাসন ব্যবস্থায় দেশ
স্বাধীণ হয়েও ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত আজও বিশ্বাস করে
ব্রিটিশের ভারত শাসনের আগে ভারত এক গরীব পিছিয়ে পড়া দেশ ছিল, ব্রিটিশরা না এলে
ভাকত পড়ে থাকত মধ্যযুগে, তথাকথিত নতুন প্রযুক্তি আর সমাজের বিকাশ ঘটত না। ব্রিটিশ যে
শিক্ষাব্যবস্থার বীজ রোপণ করে গিয়েছে, সেই বীজ আজ মহীরূহ হয়ে শহরে শহরে ছড়িয়ে
পড়েছে।
ব্রিটিশ সরকার দেশের অকেন্দ্রীভূত
শিক্ষাব্যবস্থাকে ভেঙে, এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার বীজ রোপণ করে গিয়েছিল, যে
ব্যবস্থায় ভারতের বাস্তব সামাজিক পরিস্থিতির বিন্দুমাত্রও যোগাযোগ
ছিলনা। যোগাযোগ থাকুক এমন কেনো উদ্দেশ্যও তাদের ছিল না। তত্কালীন
বঙ্গের মহাবলীরা যে সময় হিন্দু কালেজ থেকে সে যুগে মাসে পাঁচ টাকা(ঠিক সেসময়
কলকাতায় বিদ্যাসাগরমশাইএর পিতাঠাকুর ঠাকুরদাসমশাই দুটাকা রোজগার করেই নিজেকে
স্বচ্ছল এবং গাঁয়ে অর্থ পাঠাবার যোগ্য ভাবতে শুরু করেছিলেন) দেয় অর্থে ব্রিটিশ
পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেছেন, তাঁরাও বিচ্ছিন্ন থাকতে চেয়েছিলেন কীনা সে বিষয়ে অনেকেই
অনেক কথা লিখেছেন – বিশেষ করে ভারতের নবজাগরণ বিষয়ে
গবেষণায় এধরণের অনেক তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সমস্যা হল,
যে সব বামপন্থী, ডানপন্থী অথবা মধ্যপন্থী গবেষক এই বিচ্যুতি নিয়ে আলোচনা করেছেন,
তারা প্রগতিকে দেখেছেন ব্রিটিশিয় প্রগতির শিল্পবিপ্লবীয় মাপকাঠিতে। ফলে দেশের
মানুষ যখন স্বাধীণতা ঘোষণা করছেন, যখন গ্রামে গ্রামে সেনা আর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
ফলে উদ্ভুত নব্য জমিদারদের লেঠেলরা মানুষমারার রক্ত হোলি খেলছে, দেশের
সমাজ-শিল্পধংস করার পরিকল্পনায় মাতোয়ারা, শিল্পভিত্তিক গ্রামের পর গ্রাম মানুষ
বাপদাদার বৃত্তি থেকে উচ্ছেদ হয়ে মজুরে পরিণত হচ্ছে, ভারতের অকেন্দ্রিকৃত সমাজের
পরিকাঠামো ভেঙে যখন ব্রিটিশিয় নানান পরিকাঠামোর বীজ বোণা হচ্ছে, তখনকার অবস্থা
বিশ্লেষণে গবেষকেরা হাহুতাশ করছেন যে, কেন বড় শিল্প স্থাপনে ভারতের ধণীরা উদ্যোগী
হচ্ছেন না, ভারত তথা বাঙলার সমাজ ভেঙে কেন ব্রিটেনের সমাজের মতকরে ভারত তথা
বাঙলাকে গড়ে তোলা হচ্ছে না।
ডান, বাম, সাবঅল্টার্ণ সব ঐতিহাসিক-গবেষকই
ব্রিটিশ তথা ইওরোপের বিকাশের পথকেই একমাত্র বিকাশের পথরূপেই দেখেছেন।
সাবঅল্টার্ণরা বলছেন ব্রিটিশেরা ভারতে অমিত অত্যাচার চালিয়েছে, ব্রিটিশেরা যাকে
ডাকাত বলেছে, তাকে আমরা স্বাধীণতা সংগ্রামী বলছি। ঠিকই। অসম্ভব
সাধুবাদযোগ্য প্রকল্প। কিন্তু, এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও হয়ত পরোক্ষে মানতে বলছেন,
ব্রিটিশদের তৈরি করা প্রায় সবকটি পরিকাঠামো, দর্শণ প্রগতিশীলতার লক্ষণযুক্ত।
আমলাতন্ত্র, শিক্ষাব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থার আদতেই কিন্তু ন্যায়ের ধারণা
ভিত্তিকরেই গড়ে উঠেছে। ভারতে সার্বজনীক ন্যায়ের ধারণাটি পশ্চিমের কাছ থেকে
পেয়েছে, এ তথ্য লেখকদের ই-মেল করে দাবি করেছেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহন। ফলে দেশের
গ্রামীণ মানুষ এক তিমিরে ভাবছেন, জাবন ধারণ করছেন, ঠিক বিপরীতে শহুরে, উচ্চবর্ণ
অথবা পড়াশোনা করে প্রায়উচ্চবর্ণ হয়ে ওঠা মানুষেরাও ইংরেজি পদ্ধতিকেই নিজেদের সমাজ
বিকাশের মোক্ষরূপে ভাবছেন। শহরে এসে উচ্চবর্ণের দেখানো পথকেই
নিজেদের বিকাশের পথরূপে ভাবছেন। ভাবছেন সেই বিকাশের পথ রূদ্ধ
করতুলছে উচ্চবর্ণ। শহরে এসে সকলেই কমবেশি নিজেরমতকরে উচ্চবর্ণীত হয়ে উঠছেন। আদতে
ব্রিটিশ এককেন্দ্রিক দর্শণ চারিয়ে যাচ্ছে প্রায় প্রতিটি ইংরেজি জানা মানুষের মধ্যে। এরমধ্যে
হয়ত হাতেগেণা কয়েকজন ব্যতিক্রমমাত্র।
No comments:
Post a Comment