এখনও বলা যাবে না, কী পরিবর্তন হতে পারে ছোট-মাঝারি জলধারাগুলির
গতিপথে। যে দ্রষ্টব্যকে
দেখবার জন্য এত আকর্ষণ, আয়োজনের চাপে অনির্দিষ্টকালের
জন্য বন্ধ হয়ে গেল সেই গৌরীকুণ্ড-কেদারনাথের
পথ। সঙ্গে গেল মানস সরোবর যাওয়ার রাস্তাও। ধ্বংস হয়ে গেল কত যে ধাপ-খেত, যা এখানকার মানুষদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে অভ্যস্ত ফসলভাণ্ডার।
যে-সব ধাপ-খেত তৈরি করতে এক-দুই প্রজন্মের পরিশ্রম লাগে। হিমালয়ে শত শত বছর ধরে বহু মানুষ স্বয়ংভর ভাবে বাস করে এসেছেন, পালন করে এসেছেন সহস্র সাধুসন্ন্যাসীকে, আতিথ্য দিয়েছেন সাধারণ তীর্থযাত্রীদের। দায়িত্বজ্ঞানহীন
‘ভ্রমণশিল্প’ সেখানে উদ্যোক্তাদের
কিছু-দিন কিছু আর্থিক সুবিধা দিলেও অঞ্চলের ভৌগোলিক ও সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার অত্যন্ত ক্ষতি করে।
এ বারের বিধ্বংস যে অবশ্যম্ভাবী
ছিল, তার সাক্ষ্য দেবে ২০১২ সালের ৩-৪ মে উত্তরকাশীর বিরাট ধস। জনপদের অর্ধেকটা ভেঙে নেমে গিয়েছিল। গত বছর ১৩-১৪ সেপ্টেম্বর উখিমঠে ধস ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৬৯ জন। তা সত্ত্বেও এ বার, এই পাহাড়ি বর্ষার দিনে, সেই ধসপ্রবণ অঞ্চলে গঙ্গোত্রী হরশিল গাঙনানি উত্তরকাশী রুদ্রপ্রয়াগ
গোবিন্দঘাট গৌরীকুণ্ডের মতো পলকা জায়গায় ছ’তলা আটতলা আশ্রম-ভবনে হোটেলে ধর্মশালায় ৬ ২৪টি বাঁধের নির্মাণ বন্ধ করার যে পরামর্শ দিয়েছিল, তাও সরকারের জলবিদ্যুত্ মন্ত্রক কারণ না দেখিয়েই অগ্রাহ্য করেছে। সমস্ত অঞ্চলটির স্থিতিস্থাপকতার
দিকে লক্ষ্যমাত্রা না-করে কেবল নির্মাণ ও অন্য কয়েকটি সংশ্লিষ্ট লবির জোরেই গাড়োয়াল হিমালয়কে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন, বিশেষত যখন দেখা যায় অসিগঙ্গা, বিরহীগঙ্গা,
ধৌলিগঙ্গার মতো ধারাগুলির ওপর নির্মিত বাঁধের বিদ্যুত্ উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা
সাড়ে চার মেগাওয়াট, সাত মেগাওয়াট, পাঁচ মেগাওয়াট ইত্যাদি, যে বিদ্যুত্ সরবরাহ করতে গিয়েই খরচ হয়ে যায় এক-তৃতীয়াংশ (ট্রান্সমিশন
লস)।
প্রকৃতি স্বয়ং আপত্তি ব্যক্ত করলেন এই অবিমৃশ্যকারী
ঔদ্ধত্য সম্পর্কে। ধৌলিগঙ্গা প্রজেক্ট ডুবে গেছে। বদ্রীনাথের
কাছে কালীগঙ্গা প্রজেক্ট ভেঙেছে। ভেঙেছে মন্দাকিনীর ওপর ফাটা প্রজেক্ট। শ্রীনগর শহরের অর্ধাংশ কাদায় ডুবিয়ে ভয়ানক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অলকানন্দার বাঁধ। ওই এলাকায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত
বাঁধ কমপক্ষে ১২টি। এ-সব বাঁধ নির্মাণ নিয়ে কিন্তু কংগ্রেস ও বিজেপির কোনও মতানৈক্য দেখি না। যে নরেন্দ্র মোদী স্পর্ধাভরে কেদার মন্দির সংস্কারের টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেন, গঙ্গা রক্ষার বিষয়ে তাঁর মুখে একটি শব্দও শোনা যায় না। মনে পড়ে, বাজপেয়ী সরকার যখন আপার গঙ্গা বেসিনের বাঁধগুলিকে অনুমোদন দেয়, কংগ্রেস ‘চোখ বুজে কোন কোকিলের দিকে’ কান ফিরিয়ে রেখেছিল। সরকার ও বাজারের এই সংবেদনশূন্য ঔদ্ধত্যই হরিদ্বারের গঙ্গার মাঝখানে বিকট শিবমূর্তির স্পর্ধা বানিয়ে তোলে হিমালয়ের নদী-অরণ্যের সম্ভ্রম ধ্বংস করে। কিন্তু যথেচ্ছ নিয়মভঙ্গের শাস্তি পেতে হয়। প্রাকৃতিক নিয়মের শক্তি অহঙ্কৃত স্পর্ধায় প্রকাশমান নয়, কিন্তু দুর্বলও নয় তা। বদ্রীনাথ থেকে ৫২টি ধারা জড়ো করে নেমে আসা অলকানন্দা, মন্দাকিনী, শত শত ধারায় অবতীর্ণা হিমালয়নন্দিনীরা
অমোঘ শক্তি ধরে। ক্রমাগত বেনিয়মের উদ্ধত আঘাত নিজেই প্রত্যাঘাত
আহ্বান করে এনেছে। ১৫-১৬ জুনও বিপদসংকেত মাত্র। ক্ষমতাপক্ষের
প্রতি। হয়তো এখনও সময় আছে সংযত, স্বাভাবিক হওয়ার।
আনন্দবাজার পত্রিকা
No comments:
Post a Comment