আবারও বলা যাক, বংশ পরম্পরায়
এই তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীদের হাত ধরে আজও বেঁচে এসেছে এ দেশ, ভারতবর্ষের উত্পাদন
ব্যবস্থা, সর্বোপরি ভারতীয় গ্রামীণ সমাজ। ইংরেজদের বলপ্রয়োগে পরিকাঠামো
ধংসযজ্ঞের পরও যতটুকু পরিমান ভারতের উত্পাদনব্যবস্থা বেঁচেবর্তেছিল, সেই উত্পাদন
ব্যবস্থার অস্তিত্ব নির্ভর করত দেশিয় এই তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীদের ব্যবসার জ্ঞাণে,
পরিশ্রমে আর ভালবাসাসম ব্যবসায়। আজকের শহুরে ভারতের জ্ঞাণচর্চা
নিজের চিরাচরিত পথ থেকে সরে, সরাসরি শেকড়ছেঁড়া পশ্চিমি জ্ঞাণ ও বিদ্যাচর্চার
ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, যার মূল মন্ত্র আর দর্শণ, সনাতন ভারতের অকেন্দ্রিকৃত
সামাজিকতার দর্শণের সরাসরি বিপরীত। ভারতে আজ জ্ঞাণ ও বিদ্যাচর্চার
প্রাঙ্গণে তাই ব্রাত্য তৃণমূলস্তরের ব্যবসার উদ্যমের নানানস্তর, নানান দিক চর্চার
বিষয়টি। এর একটি বড় কারণ হল শিল্পবিপ্লব নির্ভর পশ্চিমি সভ্যতা
কেন্দ্রীকরণের দর্শণে বিশ্বাসী এবং সেই দর্শণ ভিত্তিকরেই গড়ে উঠেছে মূলগত পশ্চিমি
জ্ঞাণচর্চার প্রক্রিয়া, সেই পরিবেশে ভারতীয় গুণীদের জ্ঞাণের বিকাশ। উল্টোদিকে
ভারতীয় গ্রামীণ সমাজের তৃণমূলস্তরের নানান উদ্যম সামগ্রিকভাবেই বিকেন্দ্রিকৃত
দার্শণিকতার ভিত্তি।
তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীরা এই
ভারতীয় সমাজেরই অন্যতম বিকাশ শৃঙ্খল। সমাজের অন্যান্য অংশেরমতই তাঁরা
তাঁদের অবদান পেশ করে এসেছেন হাজার হাজার বছর ধরেই সমাজের রীতি নীতি মেনেই,
সামাজিক নানান বিধিবাধাবন্ধন মান্য করেই। শিল্পবিপ্লবোত্তর পশ্চিমি
ব্যবসায়ীরা সমাজ শৃঙ্খলের সমস্ত বেড়াজাল ভেঙে পৃথিবীকে শোষণ করে ব্যক্তিগত
সম্পত্তির পাহাড় বানিয়ে বিশ্বকে, মানব সভ্যতাকে ঠেলে দিচ্ছেন ধংসের মুখোমুখি,
তখনই ভারতের তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীরা, যাদের অন্যতম অংশ এই পথ ব্যবসায়ীরা,
সেরিবা-সেরিবানের উত্তরাধিকারীরা, আজও চেষ্টা করে চলেছেন যতটুকু তাঁরা রোজগার
করছেন, তাদের ব্যবসার জ্ঞাণের এক অংশ সমাজগঠণের কাজে লাগাতে, মুনাফা একহাতে জড়ো
না করে সমাজের নানান অংশিদারের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। বংশ
পরম্পরায় তাঁরা সেই নৈতিকতা এবং সামাজিক ব্যবসার ধর্ম, জ্ঞাণটুকু অর্জন করেছেন। এই
বিশ্বায়ণের লুঠেরা বাজারেও পথ ব্যবসায়ীরা যতটাসম্ভব পরম্পরা মেনে দেশিয় নানান
দ্রব্য নিজেরা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন নানান লোভ লালসার বেড়াজাল পেরিয়েও।
ভারতীয় শহুরে ব্যবসায়ীদের
সঙ্গে তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীদের ব্যবসার পারস্পরিক রীতিনীতি সম্পূর্ণভাবে
বিপরীতধর্মী হলেও, একটিমাত্র বিন্দুতে তারা পরস্পরের সঙ্গে মিলতেন, সেটি হল
সামাজিক নিয়ন্ত্রণ মেনে ব্যবসা – দেশেই হোক আর বিদেশের মাটিতেই
হোক, সমবায়িক সমাজের সুকঠোর অকেন্দ্রিভূত দর্শণের রীতিনীতি মেনে চলতেন তাঁরা। অন্ততঃ
ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য স্থাপণের পূর্বে, ভারতীয় বণিকেরা সমাজের এঁকে দেওয়া
সামাজিক রীতিনীতিবিশিষ্ট অদৃশ্য লক্ষণরেখা টকপাবার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করেননি। একরমই ছিল
বণিকদের ওপর সমাজের নিয়ন্ত্রণ। অথচ এর তুঙ্গবিপরীতদর্শণবিন্দুতে
দাঁড়িয়ে ইংলন্ডের শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে সারা বিশ্বের সম্পদ লুঠ করতে বণিকের
তুলাদন্ড, শাসকের রাজদন্ডে পরিণত হয়েছে অবলীলায়। বিশ্বের
নানান প্রান্তের নানান দেশের নানান সমাজের প্রকৃতিক, সামাজিক, পরমার্থিক নানান
ধরণের সম্পদ লুঠ আর চুরি (যে কোনও সমাজেই
তথ্য, জ্ঞাণ, সম্পদ আহরণের সূত্র লোপাট করে ফেলাকেই চুরি বলে বোধহয়) করে, এমনকী
বলপ্রয়োগে নিজের দেশেরও সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ভেঙে, মাটির তলার সম্পদকে প্রাকৃতিক
সম্পদ আখ্যাদিয়ে, বলপ্রয়োগ করে দখল করে, কয়েকজন হাতেগোণা বণিকের উদ্যমে বিশ্বপণ্য,
বিশ্বসম্পদ বাজার দখলের চেষ্টা শুরু হয়েছিল। মনেরাখতে হবে, ভারতীয় বণিককে সেই
অবাধ বাণিজ্যের, অবাধ উত্পাদনের ছাড়পত্র শহুরে অথবা গ্রামীণ সমাজ কোনও দিনই দেয়
নি।
একদা বিশ্ববাজারে যেসব ভারতীয় পণ্যদ্রব্য প্রায় একচেটিয়া ব্যবসা করত সেগুলোর মধ্যে
কাপড় ছোপানোর নীল রং যার ব্যবসায়ী নাম ইন্ডিগো, অথবা ডেকরা কামারদের তৈরি
লোহারমন্ড, তাঁতিদের তাঁত অথবা রেশম তন্তু, বাঙলার সুপুরি, হাতি ইত্যাদি ছিল
অন্যতম চাহিদাবন্ত পণ্যবস্তু।
No comments:
Post a Comment