বাঙলার ব্যবসায়ী সংক্রান্ত
স্তবকে যে ব্যবসায়ীদের কথা উল্লিখিত হয়েছে, তা মূলতঃ বড় পাইকারি ব্যবসায়ীদের কথা। শুধু
ইওরোপিয় ব্যবসার দার্শণিকেরাই নয়, বাঙলার তথা ভারতের ব্যবসায়ীদের কথা আলোচনায়
এতদিন শুধু বড় ব্যবসায়ীদের কথা আলোচিত হয়ে এসেছে, সে বুদ্ধসখা-অনুগামী নানান
শ্রেষ্ঠীপুত্ররাই হোন অথবা বাঙলার নানান কাব্যে উল্লিখিত বিদেশে বাণিজ্যে যাওয়া
প্রখ্যাত শ্রেষ্ঠীরাই হোন। ইংরেজের তৈরি করে দেওয়া দার্শণিক ও
জ্ঞাণচর্চার প্রথার বাইরে বেরিয়ে এসে বাঙলা তথা ভারতের নতুন করে পরিচয় খোঁজার
সময়ে, এই কাজটি আজও যদি বক্ষ্যমান পুস্তকের সম্পাদকেরাও করেন, কেন্দ্রিকৃত দর্শণের
পথে হাঁটার চেষ্টা করেন, তাহলে কিন্তু তারাও অন্যদেরমত একদেশদর্শীতার অভিযোগে
অভিযুক্ত হবেন। তাই সময় এসেছে তৃণমূলস্তরের যে সব ব্যবসায়ী
গোষ্ঠী-মানুষ তাঁদের নিজেদের পরিচয়ে স্বীকৃত হন নি, তাঁদের আজ স্বীকৃতি দেওয়ার
উদ্যম গ্রহণের। অস্বীকার করার যুক্তি নেই যে বড় পাইকারি বৈদেশিক
ব্যবসায়রত ব্যবসায়ীরা ভারত তথা বাঙলার সমাজের সাবেক উন্নতিতে অভূতপূর্ব সাহায়তা
দিয়েছেন। বিশেষ করে বিশ্বের নানান প্রান্তে বাঙলা তথা ভারতীয় ছোট
উত্পাদকদের নানান সূক্ষ্মতম শৈল্পিক পণ্যদ্রব্যের বাজার তৈরি করে ভারত তথা বাঙলার
তৃণমূলস্তরের কারিগর ও শিল্পীদের বিশ্বের মানচিত্রে নতুন করে স্থান করে দিয়েছেন। তাই এতদিন
ধরে যে সব পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞাণচর্চাভিত্তিক ভারতীয় ব্যবসা আর ব্যবসায়ীদের নিয়ে
গবেষণাকর্ম হয়েছে তাতে একটা বড় পরিশ্রম ব্যায়িত হয়েছে বিশ্ববাজারে ভারতীয় পাইকারি
ব্যবসায়ী আর তাদের ব্যবসার নানান উদ্যম, প্রক্রিয়া বিশ্লষণে। ভাল কথা
সন্দেহ নেই। বহু গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা, প্রখ্যাত গবেষক এই বিষয়ে
নিরবিচ্ছিন্নভাবে কাজ করেছেন, সমৃদ্ধ ভারতের অর্থনীতির নানান পরিকাঠামো তুলেধরেছেন
তা সাধুবাদযোগ্য। গৌতম ভদ্র, অশীন দাশগুপ্তেরমত প্রথিতযশা ঐতিহাসিকদের
ক্ষুরধার বিশ্লেষণী মস্তিষ্ক এই উদ্যমকে নতুন আলোয় দেখাতে চেষ্টা করেছেন।
অথচ বিশ্ব বাজারের ভারত তথা
বাঙলার সাফল্যের বাইরেও বড়রকমভাবে ভারতমহাদেশিয়স্তরে, আঞ্চলিকস্তরে,
স্থানীয়স্তরেও নানানস্তরীয় সমাজে লাভজনকভাবে ব্যবসা হত, সে তথ্য কিন্তু মধ্যবিত্ত
গবেষক ঐতিহাসিকদের খুব একটা নজরে সহজে আসে নি, হাতেগোণা কয়েকজনের কাজ ছাড়া। এদের
মধ্যে চিত্তব্রত পালিত, প্রাঞ্জলকুমার ভট্টাচার্য, ইন্দ্রজিত রায় প্রভৃতি অন্যতম। সেই ব্যবসা
সম্পাদন করতেন কারা সেই প্রশ্ন আজ তোলা নিতান্ত করণেই দরকার। শহরবাজারের
আপাত ঔজ্জ্বল্যের বাইরে যে বিশাল গ্রামীণ জনসমষ্টি বাস করতেন, যাদের বাস্তবিক
চাহিদা নিতান্তই স্বল্প, গৃহস্থালিরর দৈনন্দিনের নানান অগৌরবমন্ডিত অথচ বর্ণময়
কর্মসম্পাদনে, নানান ব্যক্তিগত অথবা গোষ্ঠীগত আচার-আচরণ পালনে,
পুজা-পার্বণ-উত্সবে, বছরভর নানান সাংস্কৃতিক ক্ষুত্পিপাসা মেটাতে, সামাজিকতার
নানান গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সম্পাদনে, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের সমাজের উত্পাদকের
উত্পাদিত পণ্য ন্যুনতম পরিমানে প্রয়োজন হত সারা বছর জুড়ে। সেই চাহিদা
কারা পূর্ণ করতেন, কিভাবে পূর্ণ করতেন, সেই প্রশ্ন আজকে তোলা অবশ্যই প্রয়োজন। লেখকদের
ধারণা এর উত্তরেই লুকিয়ে থাকতে পারে চোখে না দেখতে পাওয়া ভারতের তৃণমূলস্তরের
উত্পাদন আর ব্যবসার পরিকাঠামোর ভিত্তিমূল। বিশেষ করে ভারতের এক এলাকার উত্পন্ন
দ্রব্য অন্য এলাকায় বয়ে এনে, সেই বাণিজ্য কী ভাবে সম্পাদিত হত তার পদ্ধতিও আলোচনায়
নিয়ে আসা জরুরি। পাইকারি ব্যবসায়ীদের আপাত প্রাচারমাধ্যমের ঔজ্জ্বল্যের
পাশাপাশি দেশজ বাজারে সক্রিয়ভাবে, সমাজের রীতিনীতি মেনে অংশগ্রহণের কাজটিও যে কোনও
ভাবেই ন্যুন ছিলনা, সেই কথা কম্বুকণ্ঠে ঘোষণার সময় এসেছে আজ। এই চোখে
দেখা না যাওয়া ব্যবসার কাজটি অসম্ভব প্রার্থিত দক্ষতায় রূপায়িত করতে পারতেন
ভারতজোড়া তৃণমূলস্তরের সমাজভিত্তিক ব্যবসায়ীরা। বিশ্বে
ভারতের আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের অবদান নিয়ে বহুআলোচনা হয়েছে কিন্তু তার
কয়েকভগ্নাংশও যদি ভারতে ভারতীয় তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীদের কর্মকান্ড নিয়েও আলোচিত
হত, তাহলে কিন্তু নতুন উদ্যম, নতুন অবদানের, ভারতীয় সমাজের নতুন পরিচয় পাওয়া গেলেও
যেতে পারত।
বাঙলার ব্যবসা এবং নানান
ব্যবসায়ীদের আলোচনায় আমরা দেখেছি, ইংরেজ আমলে ইংরেজ আশ্রয়ে না থাকা
আমবাঙালি-ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং তাদের ব্যবসার পরিকাঠামো সবলে ভেঙেদেওয়া হয়েছে। এই কাজে
ইংরেজ শাসক বণিকদের সহায়তা দিয়েছেন বাঙলারই কিছু ইংরেজ আশ্রিত প্রখ্যাত ধনী, দাদনী
বনিকেরা। ইংরেজরা গায়ের জোরে বাঙলায় আমপাইকারি ব্যবসায়ীদের
ব্যবসা দখল করে নেয়। গ্রামীণ উত্পাদকদের পণ্যদ্রব্য সম্বল করে তৃণমূলস্তরে
যে সব বাঙালি ব্যবসায়ী কাজ করতেন, সেই ব্যবসা ধংসকরার কাজ করেছেন ইংরেজ প্রশাসক
এবং ইংরেজের প্রাসাদধণ্য বাঙালি ব্যবসায়ীরা। দেশের উত্পাদন পরিকাঠামো ভাঙার পর,
বিশেষ করে ইংলন্ডের দৈত্যমস বড় বড় কলে উত্পাদিত পণ্যদ্রব্য গ্রামেগঞ্জে
বিক্রিকরতে বাঙলার তৃণমূলস্তরের ব্যবসায়ীদের শ্রমে তৈরি গ্রামের বাজার দখল করা
উদ্যম নেওয়া হয়েছিল ইংরেজ অথবা তার আশ্রিত ব্যবসায়ীদের নানান প্রচেষ্টার দ্বারা। বাঙলা
সাহিত্যে এই পর্বের খুব বিস্তৃত উদাহরণ না পাওয়াগেলেও কিছুটা চন্ডীচরণ সেনের নন্দকুমার
এবং... উপন্যাসে, রবীন্দ্রনাথের ঘরে বাইরে উপন্যাসে অথবা চারণ কবি
মুকুন্দদাসের নিরন্তর অতিমানবিক সংগ্রামের গানে, নিতান্ত কিছু অখ্যাত সাধারণ
সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে এই সংগ্রামী পরিস্থতির তুল্যমূল্য কিছু উদাহরণ পাওয়া যাবে। আজ, এই
বিশ্বায়িত ভারতের বদলে যাওয়ার তরল সময়ে সেই উদাহরণ একটু কষ্টকরে খোঁজার চেষ্টা
করতে হবে। গ্রামেগঞ্জে বাঙলার হাতেবোনা তুলনামূলকভাবে দামি
কাপড়ের বদলে, মিলের শস্তাতম কাপড়, বিদেশি কাঁচের চুড়ি, রামমোহন রায়ের সুপারিশে ব্রিটিশ
নুন খাওয়ানোসহ নানান উত্পাদিতদ্রব্য বিক্রির প্রচেষ্টা খুব সম্ভব খুব বেশিভাবে সফল
হয় নি। সমগ্র ভারতের কথা লেখকেরা হয়ত বলতে পারবেন না, কিন্তু
বাঙলার প্রণম্য গ্রামীণ মানুষ বহু সময়েই সে সব বিদেশি পণ্যদ্রব্য প্রত্যাখ্যন করার
চেষ্টা করেছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, তার প্রমাণ আজও রয়েছে সমাজ জুড়ে।
বাঙলার গ্রামীণ মানুষদের আজও
তাঁর নিজস্ব সভ্যতার প্রতি টান বিগত আড়াইশ বছর ধরে ভেঙে পড়া সময়েও অটুট রয়েছে। অটুট রয়েছে
নিজেদের অবাধ ভালবাসা দিয়ে তৈরি দেশজ সমাজের নানান সূত্রের প্রতি অসম্ভব আস্থারভাব। ১৭৬৩ থেকে
ফকির-সন্ন্যাসীদের লড়াইতে ভারতজোড়া যে ব্যাপক স্বাধীণতা সংগ্রামের শুরু, সেই
স্বাধীণতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় দেশস্বাধীণ হয়েছে, আমরা সকলেই অসীম গর্ব অনুভব
করেছি। সত্যিই। কিন্তু স্বাধীণতার পর মধ্যবিত্ত
ভারতের শাসন ক্ষমতা দখলের পর, বিপরীতে গ্রামীণেরা কী দেখলেন! গ্রামীণেরা নিজের
অভিজ্ঞতায় দেখেছেন স্বাধীণতার পরও ইংরেজদের অনুসৃত নানান সামাজিক, রাষ্ট্রীয় নীতির
মৌলিক কাঠামোর খুব বেশি পরিবর্তন হল না। বিদেশি অনুসৃত নীতিগুলির ভারতীয়করণ
হলমাত্র। পঞ্চতন্ত্রের দর্শণ অনুসরণে বলাযায়, কে যেন কার চামড়া
গায়ে পরে মনভোলাবার কাজ করেচলেছে। গ্রামীণ ভারত জানে দেশে মৌল
পরিবর্তন আসে নি। ১৭৬৩থেকে দেশের গ্রামীণ বিদ্রোহী মানুষেরা অনেকে
তাদেরমতকরে নানাভাবে স্বাধীণতা সংগ্রামের দীপ জ্বালিয়ে চলেছেন – কেউ সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ ধরেছেন কেউ বা এই রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অংশ না
নিতে বদ্ধ পরিকর, কেউবা পুরাতন সমাজব্যবস্থায় টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর।
No comments:
Post a Comment