যে তর্কাতীত জ্ঞানের কথা বিজ্ঞান বলল সেটি কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বাইরে
রেখে দেওয়া হল – এটিকে দরদামযোগ্যতার বা পছন্দের বাইরে রাখা হল। ফলে বৈজ্ঞানিক
জ্ঞানের বাইরে অন্য ধরণের জ্ঞানকে পছন্দ করার সুযোগ দেওয়া হল না। বলে দেওয়া হল
বৈজ্ঞানিক জ্ঞান একমাত্র সত্যজাত জ্ঞান। কারোর পক্ষে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে প্রশ্ন
করার, বাতিল করার সুযোগ দেওয়া হল না, যেভাবে যে কেউ ধর্মীয় বা শৈল্পিক জ্ঞানকে
বাতিল করে(এবং সে কাজে উৎসাহও দেওয়া হয়)। যদি কোন ব্যক্তি বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের মৌলিক
বিশ্বদৃষ্টিকে বাতিল করার ঝুঁকি নেয়, তাকে শুধু অশিক্ষিত বলে দেওয়াই হল না, তাকে
নিন্দুক(এবং নিন্দনীয়), অযৌক্তিক এবং বিপথগামীও দাগিয়ে দেওয়া হল।
এখানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখা দরকার। প্রথমটি হল ভ্রমপ্রবণ মানুষ(fallible beings) আরও ভ্রমপূর্ণ প্রমানপত্র যুক্তিকে সঙ্গী করে দাবি করছে সে অভ্রম জ্ঞান
উৎপাদনের এবং বিশ্লেষণের পদ্ধতি তৈরি করেছে। দ্বিতীয়ত যুক্তিবাদকে সংকীর্ণ এবং পক্ষপাতদুষ্ট বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতায় নামিয়ে আনা, যার সঙ্গে মানুষের মন কিভাবে ভাবে তার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই,
যদিও এটি দিয়ে বোঝা যায় হাতে গোনা মানুষ কিভাবে ভাবনা চিন্তা করতে পারে।
যেহেতু পশ্চিমি আধুনিক বিজ্ঞানের একটাই লক্ষ্য ক্ষমতা দখল,
তাই সে যাকে প্রকৃতি বলে দাবি করে, তাকে প্রশ্ন করে এমন কোন দাবি গ্রাহ্য করা তার
পক্ষে বিপজ্জনক। তার দাবি যে সে সব ধরণের জ্ঞানচর্চায় মাথা ঢুকিয়ে মধ্যস্থ হিসেবে
কাজ করবে এবং এমন ভাব দেখায় যাতে এই কাজটা সে নিরপেক্ষ ভাবে করছে। আধুনিক
বিজ্ঞানের শংসাপত্র দেওয়ার সুযোগ যতই বাড়ল, সে ততই অগণতান্ত্রিক হয়ে উঠতে শুরু
করে। এবং জ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশাধিকার দেওয়া হতে শুরু করল বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তকে
এবং বিশেষভাবে দক্ষদের। এই জ্ঞানের বাইরের মানুষকে শুন্যমনা হিসেবে দ্যাখা হতে
থাকল এবং মনে করা হতে শুরু করল এই শূন্যস্থানে বিজ্ঞানের নানান তথ্য পুরে দেওয়ার
উপযোগী সে। তার জ্ঞান এবং জ্ঞানের অধিকার থেকে চ্যুত হল।
এখানে আরেকটি বিরোধাভাস আছে। এত দিন বলে আসা হয়েছে
বৈজ্ঞানিক যুক্তি ব্যক্তি নিরপেক্ষ এবং ব্যক্তি কেন্দ্রিক স্বেছাচারিতামুক্ত। সে
এমন কিছু সূত্র আবিষ্কার করছে যা মানব নিরপেক্ষ। অথচ এই শংসাপত্র দেয় ব্যক্তি, এমন
ব্যক্তি যাদের স্বার্থ নিহিত রয়েছে বৈজ্ঞানিক ক্ষমতায় সাপেক্ষে এবং অধিকাংশের
জীবিকা নির্ভর করছে এই ক্ষমতার চলনের ওপর। ভ্রান্তশীল মানুষ তার শিক্ষার সঙ্গে
যুক্ত সম্মানকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশিদার হয়। ব্যালটকে সুস্পষ্টভাবে
প্রতিস্থাপিত করা হল, অনুমান নির্ভর জ্ঞানচর্চার নতুন বৈজ্ঞানিক পৌরোহিত্যর
দ্বারা।
এই পদ্ধতিটি অবশ্যই গণতান্ত্রিক কাজকর্মের সম্পূর্ণ
বিপরীতাত্মক, যেখানে অধিকার অনন্য, বিশ্বজনীন এবং প্রাথমিকভাবে ব্যক্তিসাপেক্ষ,
কেননা তারা একই প্রজাতির অংশ। এই ধরণের অধিকারগুলি হল সত্য জ্ঞানের দাবির অধিকার
এবং ব্যক্তিনিরপেক্ষ জ্ঞানকে বাতিল করারও অধিকার। এটা এমন অধিকার, অন্যভাষায়
জ্ঞানকে শংসাপত্র দেওয়ার ক্ষমতার অধিকারও অন্তর্ভূক্ত। কিন্তু নতুন আধুনিক
বিজ্ঞানের স্বৈরশাসনে এই অধিকারগুলির ওপরে আঘাত হানা হল, তারপরে নষ্ট করে ফেলা হল,
এবং মনে করা হল না সাধারণ মানুষের পক্ষে তাদের নিজেদের কাজকর্মের ফল হিসেবে
বিশ্বজনীন জ্ঞান চর্চা বা জ্ঞান তৈরির করার ক্ষমতা রাখে। বৈজ্ঞানিক একতান্ত্রিকতার
আশেপাশে থাকা প্রত্যেক মানুষের হাত থেকে এই রাজনৈতিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হল। যে
সব ক্ষমতাসীন মনে করলেন মানবাধিকারকে খুব তাড়াতাড়ি গণতন্ত্রীকৃত করে ফেলা হয়েছে,
তাদের জন্য বিজ্ঞান নিয়ে এল এক হাতিয়ার যার দ্বারা সে একসময় যে অধিকার দিতে বাধ্য
হয়েছিল, তাকে ফিরিয়ে নিতে শুরু করল।
ফলে পরিকল্পনা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি – প্রকৌশলীরা –জ্ঞান
উৎসারণ দখল, মানুষের জ্ঞান উতসারণের অধিকার হরণ, জনস্বার্থের সাধারণ মানুষের যোগ
দেওয়ার অধিকার অথবা নিজেদের বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে
উঠলেন।
(ক্রমশঃ)
উলফগাং শ্যাকস সম্পাদিত দ্য ডেভেলাপমেন্ট ডিক্সনারি, আ গাইড টু নলেজ এজ পাওয়ার
থেকে
No comments:
Post a Comment