ভারতের কথা বলতে পারব না, কিন্তু বাংলায় ভদ্রবিত্তকেন্দ্রিকতা বরাবরি ছিল, যে জন্য আজ থেকে প্রায় হাজার বছরের একটু আগে সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিত লিখে, পাল রাজত্বের বিরুদ্ধে লড়ায়ে গিয়ে ক্ষমতা দখল করা কৈবর্তদের সপাটে গালি এবং কিভাবে পয়সা ছড়িয়ে ছোটলোকেদের ক্ষমতাচ্যুত করতে হয় তার নিদান দেবেন এবং মোক্ষমভাবে গোপাল-পূর্ব সময়কে অরাজক দাগিয়ে দেবেন, যে অরাজক শব্দটা তার পরে ক্ষমতাধরদের হাতঘুরে কেন্দ্রিয়ভাবে ছোটলোকদমনের রাষ্ট্র পরিচালনার তত্ত্বে পরিণত হবে; শ্রীচৈতন্যের উত্তরাধিকারী পদকর্তারা তাঁদের আরাধ্যের নাম করে গ্রাম্য সামুহিক দেবেদেবীগুলোকে অন্ধকারের-চৈতন্যের সঙ্গে তুলনা করবেন এবং অনুগামীদের এগুলি পুজন থেকে দূরে থাকতে নিদান দেবেন, তারও কয়েকশ বছর পরে এক যুগপুরুষ কলমচি হাতে কলম নিয়ে ক্ষমতার কাছে থেকে মুচিরাম নামক এক মানুষকে নয়, তার আগের ১০০ বছর ধরে গোটা ছোটলোক শ্রেণীর হাত থেকে উৎপাদন ব্যবস্থার রাশ কেড়ে নেওয়ার সাহিত্যিক প্রতিভূ হবেন।
আদতে ভারতবর্ষ আজও বিভিন্ন ধরণের সমাজের সমবায়িক ভূখন্ড, যেখানে কোথাও সদ্য বিধবা বৌকে পোড়ানো হচ্ছে তো অন্যদিকে বিধবা বিবাহ হচ্ছে, কোথাও এক পুরুষের পাঁচ বৌ, আর এক নারীর একইসঙ্গে পাঁচ বিয়ে, কোথাও বিভিন্ন ধর্ম/আচার পরস্পরের সঙ্গে গলা জড়াজড়ি করে থাকে, কোথাও পরস্পরের ওপর চড়াও হয় হাতে দা কাটারি নিয়ে, কোথাও ঘেঁটি ধরে নিরামিষ খাওয়া শেখানো হয়, কোথাও আবার সূর্যের তলায় যাই নড়াচড়া করে তাকেই নানাভাবে খাদ্য হিসেবে গণ্য করে, কোথাও মেয়েদের হাতে গোটা উৎপাদন ব্যবস্থা, কোথাও মেয়েরা এক্কেবারে পর্দানসীন। এদের কারোরই হাজার হাজার বছর ধরে একত্রে থাকতে অসুবিধে হয় নি।
এই বৈচিত্রের নাম ভারতবর্ষ। এ একটা দেশ, রাষ্ট্র নয়। ভদ্রবিত্ত গত আড়াইশ বছরে পুঁজির অঙ্কশয়ানি হয়ে মনে করেছে সেই রাষ্ট্রটার চালক, ফলে মাঝ্র মাঝে ঘুম থেকে উঠে তার মনে হয় তারা দেখছে না বলে দেশটা উচ্ছনে গেল।
অসুবিধে হল যখন কেন্দ্রিয়ভাবে ইওরোপিয় জাতিরাষ্ট্রীয় ধারণায় দেশকে বেঁধে ফেলার ঔপনিবেশিক চক্রান্তকে উত্তরাধিকারসূত্রে রূপায়ণ করার দায়িত্ব পেল দেশের ভদ্রবিত্তরা। এ নিয়ে হাজারো কথা বলা যায়। আজ তাদেরই এক উত্তরাধিকারীর থেকে অলমিতি।
No comments:
Post a Comment