পশ্চিমি বিজ্ঞানের জ্ঞানচর্চার হিংসাত্মক ক্ষেত্র বিস্তৃতি নির্দিষ্টভাবে অন্যান্য
জ্ঞানচর্চার অধিকারের ওপর দীর্ঘকালীন নগ্ন হস্তক্ষেপ। রাষ্ট্রীয় নীতি যেহেতু একটি
জ্ঞানচর্চার পৃষ্ঠপোষণা করে, সেহেতু অন্য জ্ঞানচর্চাকে সে ক্ষতিকরে এবং অগ্রাহ্যও
করে। শুধু একটা উদাহরণ নিতে পারি চিকিতসাবিদ্যা। যেভাবে ভারতীয় পদ্ধতিতে চিকিতসাকে
প্রায় উপেক্ষা করে সাগরপারের এলোপ্যাথি চিকিৎসা ব্যবস্থার পৃষ্ঠপোষণা করা হচ্ছে
সরকারি উদ্যমে, সে তথ্য নিশ্চই নথি করণ করে বোঝাতে হবে না।
সব সাম্রাজ্যই অসহমান এবং হিংসার মদতদাতা। নিজের জ্ঞানচর্চা বিষয়ে পশ্চিমি
বিজ্ঞানের ঔদ্ধত্যের দরুণ নানান বিকল্পকে সক্রিয়ভাবে ধ্বংস করে সেগুলির ওপর নিজের
নকল পদ্ধতিতে শেখা বিদ্যাটি চাপিয়ে দিয়েছে। ফলে এই পদ্ধতিটি সীমাহীন এবং স্থানীয়
হিংসা অত্যাচার সৃষ্টি করেছে এই অভিচারের ফলশ্রুতিতে আধুনিক বিজ্ঞান প্রাকৃতিক
সম্পদের ওপর অপটুভাবে এবং অযথাযথভাবে দখল নিয়েছে। যেভাবে ইওরোপ উত্তর এবং দক্ষিণ
আমেরিকা এবং বিশ্বের নানান দেশের কোটি কোটি আদিবাসিন্দাকে নির্বিচারে হত্যা করে
নিজেদের বসতি তৈরি করেছে, ঠিক সেইভাবে তাদের চিকিতসাবিদ্যা সেই দেশগুলোর
চিকিতসাবিদ্যা, সেই দেশের বীজ ইওরোপিয় বীজ দিয়ে উৎখাত করেছে। তাদের জ্ঞানচর্চাকে
তারা আধুনিক বিজ্ঞান নাম দিয়ে অন্য সব ধরণের দ্যাখা, কাজের এবং পরমার্থকে মুছে
দিয়েছে।
জ্ঞানই ক্ষমতা। কিন্তু ক্ষমতাও জ্ঞান। ক্ষমতা নির্ধারিত করে কোনটা জ্ঞান আর
কোনটা নয়। ফলে আধুনিক বিজ্ঞান তার অপ্রতিযোগী অথচ ভিন্ন ধরণের মানুষে মানুষে
যোগাযোগ, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ প্রকৃতি এবং মানুষের সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্ক
ধ্বংস করে, না পারলে তাকে ন্যুন করার উদ্যম নেয়। আধুনিক বিজ্ঞান, নিজেকে বাদ দিয়ে সব
ধরণের জ্ঞানচর্চার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যাতে নিজের সূত্র আর তৈরি করা
ধারণার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব বজায় থাকে। এই তৈরি করা ধারণাই পশ্চিমি সংস্কৃতির
আগ্রাসী রূপের সঙ্গে যুক্ত।
সাধারণভাবে একটা ভ্রম তৈরি করা হয়েছে এই বলে যে আধুনিক বিজ্ঞান, সত্য জ্ঞানের
বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। বাস্তবে এটি জ্ঞানকে মানুষের কাছ থেকে
কেড়ে নিয়েছে। সে নিজের ক্ষেত্র বিপুলভাবে বাড়িয়েছে, অন্যান্যদের ধ্বংস বা চেপে
দিয়েছে। মানুষের অভিজ্ঞতার ফসলের সঞ্চয়ের যে সম্ভাবনার সুযোগ ছিল, সেই দ্বারটাকে
সে সঙ্কুচিত করে রেখেছে। মনে হতে পারে সে বিপুল তথ্যের স্ফূরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু
তথ্য, তথ্যই, জ্ঞান নয়। শুধু বলা যায়, জ্ঞানের অবনমন এবং বিকৃতি ঘটেছে। বোঝা দরকার
বিজ্ঞানকে কিন্তু ব্যবহার করা হচ্ছে না জ্ঞান বৃদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে, বরং শুধুমাত্র
জ্ঞানের উপনিবেশ এবং নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার এবং একই সঙ্গে একটি সোজা সঙ্গীন পথে
একটি নির্দিষ্ট প্রকল্প রূপায়নের উদ্দেশ্য মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রণের জন্যে পশ্চিমি
বিজ্ঞান কাজ করে চলেছে।
তাহলে কি পরাজয় সম্পূর্ণ হয়েছে? না। আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে বিশ্বের প্রত্যেকটি
অংশ মাথা নোয়ায় নি। কৃষি ও খাদ্য ব্যবসা, পারমাণবিক চুল্লি, বিপুল বিশাল বাঁধ –
যেগুলি আদতে আধুনিক বিজ্ঞানের বাহ্যিক চিহ্ন, সারা বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধের মুখোমুখি
পড়ছে। বহু মানুষ যারা আধুনিক বিজ্ঞানের ফাঁকা ফলটি ভক্ষণ করে আপাতত মোহমুক্ত, তারা
শুধু নয়, বিপুল সংখ্যক মানুষ সেই ফলটি খেতে অস্বীকার করছে। কোটি কোটি চাষী কৃষি
ব্যবসায়ীদের হাত থেকে প্রতিদিন মুক্তির পথ তৈরি করে নিচ্ছেন, কোটি কোটি মানুষ আধুনিক
এলোপ্যাথি চিকিৎসার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আধুনিক বিজ্ঞানের
সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিকৃত নৈতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে উদগ্রীব।
স্বাধীনতার পর থেকে দীর্ঘকালব্যাপী পশ্চিমি বিজ্ঞানের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষণা সত্ত্বেও
ভারতের হৃতগৌরব ফিরে আসে নি। ১৯৭৬ সালে ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় নাগরিক কর্তব্য
হিসেবে বৈজ্ঞানিক মানিসিকতাকে যুক্ত করেছিলেন সংবিধান সংশোধন করে। এতদ সত্ত্বেও
বৈজ্ঞানিকদের সমাজে ব্যর্থতার সঙ্কট কাটে নি এবং প্রত্যেক দশকে তারা ভারতের সমাজ
থেকে বিচ্ছিন্ন হচ্ছেন।
এই বৈজ্ঞানিক ব্যর্থতার ফলে ভারতকে খুব সহজে আধুনিক পশ্চিমি বিজ্ঞানের সুতোয়
নাচানো যাচ্ছে না। অপশ্চিমি সমাজের মানুষেরা সাধারণভাবে পশ্চিমি জ্ঞানের ভাণ্ডারে
ঝাঁপ দিয়ে পড়ছেন না। বহু ক্ষেত্রে আগ্রাসীভাবে তারা অসহযোগ দেখিয়ে চলেছে। জনগণ,
গোষ্ঠী, গ্রাম সমাজ উন্নয়নের আধুনিকতাকে বর্জন করে নিজেদের পরম্পরার জীবনধারণে,
প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তা এবং পরম্পরার শিল্পচর্চায় খুশি থাকছেন। উন্নয়নের বিরুদ্ধে
বিদ্রোহ আদতে আরেক স্তরের আধুনিক পশ্চিমি বিজ্ঞান আর তার হিংসার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধতা।
এটি মহাত্মা গান্ধীর কথা। যারা প্রকৃতি ও মানুষের স্বাভাবিক অধিকার নিয়ে চিন্তিত
এটা তাদেরও কথা।
(শেষ)
উলফগাং শ্যাকস সম্পাদিত দ্য ডেভেলাপমেন্ট ডিক্সনারি, আ গাইড টু নলেজ এজ পাওয়ার
থেকে
No comments:
Post a Comment