জানি যারা আধুনিক বিজ্ঞানের যুগচরিত্র সম্বন্ধে প্রচারমাধ্যমের তৈরি করা ধারণায় স্বেচ্ছায় নিজেদের বিকিয়ে দিয়ে বসে আছেন, তাদের আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে এই বক্তব্য অবশ্যই পছন্দের হবে না এবং অশ্রদ্ধেয় মনে হতে পারে। আমাদের কাছে আধুনিক বিজ্ঞান অন্য কৃষ্টির উৎপাদন হিসেবে গণ্য হয়, এবং সে চরিত্রগতভাবেই বিদেশি। আমরা স্বাভাবিকভাবে একে যুগনির্ভর (epoch-specific), জাতিসাপেক্ষ(পশ্চিমি), কৃষ্টিসাপেক্ষ (সংস্কৃতিগতভাবে মৃত(culturally entombed)) প্রকল্প হিসেবে দেখি। এটি রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত, অচেতন বস্তু, যাকে বাইরে থেকে চেতনা জুড়ে দিয়ে বিপুল সংখ্যক মানুষের স্থিতিশীল দীর্ঘকালীন অভিজ্ঞতা, এবং দৃষ্টিভঙ্গী গ্রাস করার চেষ্টা করে। যে বিশ্বে জাঁহাবাজ(dominating) এবং অধীন সমাজের পাশাপাশি অবস্থান, সেখানে কিছু কিছু কৃষ্টি অন্যেদের থেকে একটু বেশিই সাম্যাবস্থা ভোগ করে। অসাম্যের এই ঐতিহ্য, ঔপনিবেশিক সময়ের উন্মোচিত এবং প্রোথিত হয় এবং আজ পর্যন্ত তার চরিত্র অপরিবর্তিত রয়ে গিয়েছে। ফলে পশ্চিম জাত এই কৃষ্টিগত পণ্য বিশ্বক্ষমতার সিংহাসনের সঙ্গে মিলেজুলে চলার জন্য পশ্চিমেরই বিজ্ঞান প্রাথমিকভাবে বাধ্যতামূলক কর্তৃত্বশালী এবং স্বঘোষিত বিশ্বজনীনতার রূপ পরিগ্রহণ করেছে।
আমরা আজ জেনে গিয়েছি উপনিবেশ প্রজাদের অধীনস্থ করে, নিম্নস্তরীয়দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখে এবং অধস্তন দাসে পরিণত করে, তার পরম্পরার স্মৃতি মুছে উপনিবেশজনিত উচ্চমন্যতার দৃষ্টিভঙ্গী ঠুসে দেওয়ার চেষ্টা করে। এটা তার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। যেহেতু আধুনিক বিজ্ঞান ঔপনিবেশিক ক্ষমতা বিস্তারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়েছিল, তাই নির্লজ্জভাবে এবং কার্যকরভাবে হুমকি (intimidation) দিয়ে, প্রচারযন্ত্র ব্যবহার করে, শিক্ষা আর বাতচিতের মাধ্যমে(catechism) এবং রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তার প্রভাব বিজায় রাখে। বাস্তবিক পশ্চিমি বিজ্ঞান যেহেতু একটি কৃষ্টিপণ্য, এটি কৃষ্টির নানান(অধিকাংশ আগ্রাসী) হাতিয়ারের সঙ্গে জুড়ে থাকে কর্তৃত্বস্বভাব। তার কর্তৃত্ব সমাজের অভিজাত শ্রেণীর মাধ্যমে অন্যান্য সমাজে, কৃষ্টিতে বিস্তৃত হয়, যে অভিজাতদের আজকাল সামাজতাত্ত্বিকেরা আধুনিকতার ধ্বজাধারী(modernizers) হিসেবে বর্ননা করেন, যাদের অক্সব্রিজ শিক্ষা পাওয়ার বৈশিষ্ট্যযুক্ত চরিত্রের সঙ্গে মিলে থাকে নিজের শেকড়ের, নিজের কৃষ্টির, নিজের দেশের মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকার অবশ্যম্ভাবী শর্ত। তার জন্মের সূত্র হিসেবে এই বিজ্ঞান আজও পশ্চিমের স্বার্থের ধ্বজাবাহী যা আদতে পশ্চিমের হিস্টিরিয়াগ্রস্ত দাপটের অন্যতম হাতিয়ার।
আধুনিক বিজ্ঞান বিশ্বজোড়া যে সিব কৃষ্টির ওপরে তার আগ্রাসী নখর বসিয়ে দিতে চায়, সেই কৃষ্টিগুলি অদ্ভুত এবং আত্মার অবাঙ্গমানসগোচর শক্তির জন্য পুরোপুরি সেই আগ্রাসনের অঙ্গীভূত হয়ে পড়ে না। সব সমস্যা সমাধান করে দেওয়া দাবির অসারতা এবং কিছু কিছু সমস্যাকে বোঝার সাধারণ অনতিক্রম্যতার জন্য বিজ্ঞানের এই পতন। তার সাধের কর্তৃত্বের বজ্রকঠিন শাঁড়াশি বিশ্বজুড়ে শিথিল যে হচ্ছে, সেটা তার অতিবড় উপাসকমন্ডলীরাও বুঝতে পারছে। বিভিন্ন অপশ্চিমি বিশ্বে আধুনিক বিজ্ঞান এখন টুথপেস্টের মত সাধারণ পণ্যে বা গ্যাজেট পরিণত হয়েছে – যা আজ অর্থ দিয়ে কেনা যায়। সে বিশ্বকে বস্তুবাদীদের পরমদেশে পরিবর্তন করার আওয়াজ দিয়ে বলেছিল দারিদ্র এবং দলনের পরিসমাপ্তি ঘটিবে, সে সব কোন কিছুই না ঘটায় তার বিশ্বাসযোগ্যতা আজ তলানিতে। আজ আমরা দেখাতে পারি ঠিক তার উল্টোটাই ঘটেছে। সে যে নতুন আধিবিদ্যক বিশ্বদৃষ্টি(metaphysical world-view) দিয়ে নৈতিক নির্দেশিকা(ethical guidance) দেখানোর কথা বলেছিল, সেটিও আজ বর্জিত তত্ত্ব। আজও আমাদের সমাজের প্রাথমিক উদ্যমের মূল চালিকাশক্তিগুলি ধর্ম, কথোপকথন, সম্প্রদায়, পুণ্য সংগঠনের(sacred entities) সাথে যোগাযোগ এবং তাদের সঙ্গে জুড়ে থাকা চিহ্নময়তা (associated symbols)।
(ক্রমশঃ)
উলফগাং শ্যাকস সম্পাদিত দ্য ডেভেলাপমেন্ট ডিক্সনারি, আ গাইড টু নলেজ এজ পাওয়ার থেকে
No comments:
Post a Comment