মুঘল সাম্রাজ্যের শুলইকুল(সবার জন্য শান্তি) নীতি
চন্দ্র ভান নিয়ে আরও কয়েকটি লেখা হবে। আদতে চন্দ্র ভান(বা চন্দর ভান)এর সময়টা এবং তাঁর কাজ নিয়ে যতই ভেতরে ঢুকছি দেখছি গুরুত্বপূর্ণ কতগুলি বিষয় পাক খেতে খেতে বেরিয়ে আসছে। এই লেখায় চন্দ্র ভানের মতই সে সময়ের আরেক অমুসলিম মুন্সি হরকরণ দাস কম্বুর কথা আলোচনা করব।
আমরা দেখব চন্দ্র ভানের পেশাদারি মুন্সিত্বের জীবনে আফজল খাঁ শিরাজির প্রভাব ছিল। মুঘল দরবার পর্যন্ত তার যাত্রার সঙ্গে জুড়ে ছিলেন আরও কিছু মানুষ। চন্দ্র ভানের লেখা পত্তরে জানা যায় লাহোরের প্রধান স্থপতি (মীরইইমারত) আবদ অল করিম মামুরি(স্থপতিr) তাঁর প্রথম কর্মদাতা। তিনি প্রখ্যাত হন তাজ মহলের তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়ে। তিনি ছিলেন প্রধান খাজাঞ্চি এবং আমলা। চন্দ্র ভান লিখেছেন তিনি মুল্লা আবদ অল করিমের অধীনে কাজ করে প্রচুর কাজ শিখেছেন এবং তিনি ছিলেন নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ(মখদুমই কায়দাদানই আলম) এবং asceticism, renunciation, equanimity (আবির বারয়ি ফকর ওয়া ঘিনা ওয়া কুয়াম ওয়া মুস্তাকিম) হিসেবে অমূল্য; তাঁর অধীনে কাজ শেখা যেন মুক্তোর মত দুর্মূল্য (শাগির্দয়ি আন মখদুম দুরই মুসমানই মুজাররব অসত)।
১৬১৫ সালে আবদ অল করমকে জাহাঙ্গীর মাণ্ডুর গ্রীষ্মাবাস তৈরিতে এবং সেখানকার শাসকদের স্থাপত্য সারানোর কাজে পাঠান। দুবছর পর মাণ্ডুর কাজ শেষ হলে ১৬১৭ সালের মার্চের ১৮ তারিখে আবদ অল করিমের পদবৃদ্ধি করে ৮০০ মনসবদার হিসেবে মানুর খান উপাধি দান করেন। এক মাস পরে তাকে লাহোরের প্রাসাদ তৈরি দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। হয়ত ১৬১৭-১৮র সময়ে লাহোর দুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ শেষ করার পরে চন্দ্র ভান তাঁর অধীনে কাজ শুরু করবেন। ১৭১৯এ সম্রাট লাহোরের প্রাসাদগুলি দেখতে এলে আবদ অল করিম সম্রাটের সঙ্গে থাকেন তার জন্য মনসবদারি আরও ১০০ বাড়ে।
চন্দ্র ভান দরবার পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন তার একটা বড় কারণ যে আকল খান এবং মীর আদব অল করিম দুজনের উচ্চকোটির যোগাযোগের মানুষ ছিলেন। এবং উল্লেখ্য চন্দ্র ভানের কোন পারিবারিক আভিজাত্য না থাকা সত্ত্বেও কিন্তু চন্দ্র ভান উচতম আমলা পদগুলির একটিতে বৃত হন।
চন্দ্র ভানের মত যোগাযোগ হীন, মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন সন্তান এক্কেবারে করণিক অবস্থা থেকে শুধু প্রশাসনিক উচপদে আরোহন করছেন না, তার এক সম্রাটের আমল থেকে অন্য সম্রাটের আমল পর্যন্ত বয়ে যেতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নি। রাইটিং সেলফ, রাইটিং এম্পায়ারে রাজীব কিনরা বলছেন, মুঘল সাম্রাজ্য আকবরের সময়ে গৃহীত শুলইকুল(সবার জন্য শান্তি) তত্ত্ব যা আদতে বৃহত্তরভাবে সাধারণকে পৃষ্ঠপোষণা করার নীতি, সার্বিকভাবে সব সম্রাটের আমলই পালন ও বাস্তবায়িত হয়ে এসেছে। এই নীতির জন্য চন্দ্র ভানের মত সাধারণ একজন নিম্নশ্রেণীর সাধারণ অমুসলমান করণিককে পৃষ্ঠপোষণা করতে দুজন মুসলমান উচ্চপদস্থ অভিজাতর কোন সমস্যা হয় নি।
শুধু চন্দ্র ভানএর পরিবারই বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছিল না সেই সময়। সে সময়ের অন্যতম নামি অমুসলমান প্রশাসাক মুলতানের হরকরণ দাস কম্বু, ইতিবর খান (ওরফে মুমতাজ খান)এর মুন্সি ছিলেন। ইতিবর খান ছিলেন শাহ জাহানের দরবারের গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত এবং সঙ্গী। শাহ জাহানের বিদ্রোহেরে সময় তিনি আগরার সুবাদার হিসেবে তার পাশে দাঁড়ান। চন্দ্র ভানের মতই হরকরণের পরিবারেও অনেকেই ফারসি জানতেন, এবং রাজ প্রশাসনে কাজ করেছেন। বাবা মথুরা দাসের কবি খ্যাতি ছিল। যতদূর সম্ভব দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম চিঠি লেখার মূলসূত্রটি রচনা করেন হরকরণ। ১৬২২ সালে এটির প্রাথমিক নাম ছিল ইরশাদ অল তালিবিন(ছাত্রের প্রাথমিক পাঠ), যা পরের দিকে এটি এতই বিখ্যাত হয় যে, বইটি ইনশায়ি হরকরণ (হরকরণের গদ্য লেখার মূল সূত্র ) নামে নামাঙ্কিত হয়। এই বইটি আরও দেড়শ বছরের বেশি সময় ধরে জীবিত ছিল। ১৭৮১ সালে কোম্পানির ডাক্তার ফ্রান্সিস বেলফোর গভর্নর-জেনারেল হেস্টিংসের নামে উতসর্গ করেন। ঔপনিবেশিক আমলাদের কিভাবে ফার্সিতে চিঠি লিখতে হয় সে সম্বন্ধে নির্দেশিকা হিসেবে এটি কাজ করে। এটি ভারতে মুদ্রিত প্রথম দিককার ছাপা বই।
উল্লেখ্য হরকরণের খ্যাতি কিন্তু জাহাঙ্গিরের দরবারে কাজ করার সূত্রে হয় নি, আর তিনি তার সভাসদও ছিলেন না। তিনি আজকের একজন অনামি অভিজাত ইতিবর খানের মুন্সি ছিলেন। তবুও চন্দ্র ভানের মতই হরকরণের সাহিত্য কৃতি বহুকাল বেঁচে ছিল।
No comments:
Post a Comment