কিন্তু আমরা যদি দুটি উৎপাদনের পদ্ধতি আর তাদের পণ্যের গুণমানের একটা গভীর তুলনামূলক আলোচনা করি তাহলে কিন্তু অন্য একটা দৃষ্টিভঙ্গী পাব, যখন আমরা বুঝব আধুনিক বিজ্ঞান তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অকেজো করে দেওয়ার গুণ এবং চিন্তাহীনভাবে পদ্ধতি হনুকরণ করায় ভুল মূল্যমান তৈরি হয়। সাদা চিনি শরীরের পক্ষে নানান কারণে বিপজ্জনক, সে তথ্য আমরা নানান গবেষণায় আজ পরীক্ষিত এবং প্রমানিত। দেহে প্রবেশ করে সাদা চিনি অন্ত্রের পরিপাক ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করে দিয়ে ভোক্তাকে বিপদে ফেলে। আদতে শারীরিকভাবে মানব দেহের জন্য সাদা চিনির কোন প্রয়োজনীয়তা নেই। সাদা চিনি শুধু পুষ্টিহীন ক্যালোরি এই তথ্য আজ প্রমানিত। অন্য দিকে গুড় হল খাদ্য। এতে শুধু চিনিই থাকে না থাকে ভিটামন, লোহা এবং নানান ধাতু।
ফলে দুটি মিষ্টদ্রব্য যদি আমরা তুলনা করি, তাহলে পরিষ্কার হবে যে, গুড়ই মানব সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং সাদা চিনি নয়। গুড় আর চিনির এই তুলনা শুধু আমরা এদের উৎপাদনের প্রক্রিয়ার তুলনা করে করতে পারব না। আদতে এই তুলনার পদ্ধতিটাই আধুনিক বিজ্ঞানের দক্ষতাপূর্ণ শক্তি সংরক্ষণের বাহানায় পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী। আমরা চোখ বন্ধ করে ধরেই নিই যে গুড়ের উৎপাদন প্রক্রিয়ার তুলনায় চিনির উৎপাদন প্রক্রিয়া, বিশেষ করে উভয় ক্ষেত্রে যে ধরণের প্রযুক্তি ব্যবহার হয়, চিনির ক্ষেত্রে অনেক বেশি দক্ষ। হাস্যকর হল এই দক্ষতার বিতর্কে কোথাও বলা হয় না, আমরা কোন ধরণের উৎপাদন প্রক্রিয়া বজায় রাখব, যা মানুষের শরীতে বিষজক্রিয়া তৈরি করে আর পরিবেশের ক্ষজতি করে, না যা মানুষের দেহে পুষ্টিও জোগায় আর পরিবেশকেও সুস্থ স্বাভাবিক রাখে।
একটি ইঙ্গিতময় উদ্ধৃতি তুলে দিচ্ছি, ১৯৬০ সালের আগস্ট মাসে ইসরায়েলে Role of Science in the Advancement of New States নামক কর্মশালায় পূর্ব নাইজেরিয়ার অর্থমন্ত্রী পশ্চিমি রাষ্ট্রগুলির প্রতি এস ই ইমোকে হাঁটু গেড়ে আশা করেছিলেন, আমি আপনাদের চাঁদ পেড়ে দেওয়ার কথা বলছি না বা সেখানে নিয়ে যাওয়ারও দাবি করছি না। আমরা আমাদের দেশে সম্পদ ব্যবহার করায় আপনাদের সহযোগিতা আর সাহায্যের অনুরোধ করছি, যাতে আমরা গ্রাসাচ্ছদনের স্তর থেকে সম্পদশীলতার শীর্ষে পৌঁছতে পারি।
সমাজের পুনর্গঠন
পশ্চিমে বড় পুঁজির শিল্পের পৃষ্ঠপোষণার পাশাপাশি আরও একটা একই বৈজ্ঞানিক লাইনে সমাজকে দেখার কাজ চলছিল। এই কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে দিয়েছিলেন আগস্ট কোঁত। rationality, empiricism and enlightenment এর দৃষ্টিভঙ্গীতে মানব সভ্যতাকে দেখার এই ভাবনা তথাকথিত অগ্রসর সমাজে প্রভূত প্রভাব ফেলেছিল।
কোঁতের এই তত্ত্বায়ন নতুন করে জীবনলাভ করল তৃতীয়বিশ্বের রাজনৈতিক স্বাধীনতার পর থেকে। এখানে বিজ্ঞান(যেন আদিরূপকীয় হাতিয়ার) যেন তথাকথিত গরীবদের দৈনন্দিনের ভাল থাকার সব সমস্যা সমাধানের সবখোল চাবিকাঠির কাজ করবে ধারণা করে নেওয়া হল।
এই বিশ্বদৃষ্টিমূলক উদ্যমের একটি বড় উদাহরণ স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জবাহরলাল নেহরু। নেহেরুর মত কোন তৃতীয়বিশ্বের নেতা আধুনিক বিজ্ঞানের ওপর এত গ্ল্যামারের আলো আর চাহিদার ভার চাপিয়ে দেয় নি। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞান আর উন্নয়ন পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলে। সমাজ বিকাশে বিজ্ঞানের অপরিহার্যতার কোঁতিয় তত্ত্ব নতুন করে নেহরুর কার্যকলাপে উঠে এল। তিনি ডিস্কভারি অব ইন্ডিয়াতে লিখলেন, বিজ্ঞান এবং একমাত্র বিজ্ঞানই পারে বিপুল সম্পদ ব্যবহার করে যেভাবে ধনী সমাজগুলো তার মানুষের মুখে খাদ্য তুলে দিয়েছে, তেমনি তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুধা এবং দারিদ্র দূর করতে, স্বাস্থ্যব্যবস্থা উন্নত করতে এবং অশিক্ষা দূর করতে, কুসংস্কার এবং প্রথা আর ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে।
(ক্রমশঃ)
সম্পাদিত দ্য ডেভেলাপমেন্ট ডিক্সনারি, আ গাইড টু নলেজ এজ পাওয়ার থেকে
No comments:
Post a Comment