বাংলার দেশজ প্রযুক্তি চর্চা
কংসবণিক৪
কংসবণিক৪
মনে হয় ধাতু পণ্য তৈরির কেন্দ্র দুটি ভাবে গড়ে উঠেছিল। বিষ্ণুপুরের মত কিছু
এলাকায় শাসকেরা বিভিন্ন এলাকার শ্রেষ্ঠ কারিগরদের নিয়ে এসে একটি বিপুল বড় উৎপাদন কেন্দ্র
বানিয়েছিল। ফলে এই সব এলাকায় বিভিন্ন ধরণের বিভিন্ন আঙ্গিকের কারিগরের সমাগম হয়।
অন্যান্য ধাতু উৎপাদন এলাকা তৈরি করে সওদাগরেরা, যারা কারিগরি আর বাজার উভয়ই জানে,
খুব কমসময়ের মধ্যে কারিগরদের জড়ো করে একটি বসতি স্থাপন করে ফেলতে পারে। বিভিন্ন
শহরে, যেখানে আগামী দিনের বাজার খুব ভাল হবে বলে তাদের ধারণা হয়, সেই সব এলাকায়
তাদের উদ্যোগে কারিগরদের বসতি গড়ে ওঠে।
এ ধরণের একটা কারিগরি এলাকা হল বালি, প্রখ্যাত দেওয়ানগঞ্জ বাজার থেকে এক কিমি
দূরত্বে অবস্থিত। এক সময় এই এলাকা সূক্ষ্ম রেশম এবং সুতি বস্ত্রের খুব প্রখ্যাত
উৎপাদন কেন্দ্র ছিল, এবং তাদের লুঠের সম্পদে বর্মি আর পর্তুগিজ বণিকেরা এই কেন্দ্র
থেকে কাপড় কিনত। এর একটা উদাহরণ হল এই সব এলাকায় প্রায় ধ্বংস হতে বসা সূক্ষ্মকাজ
বিশিষ্ট প্রাচীন পোড়ামাটির মন্দিরসমূহ।
এই অঞ্চলের ধাতু উৎপাদন কর্ম বেশ প্রাচীনতার ঐতিহ্যবাহী। এক সময়
বালি-দেওয়ানগঞ্জ তামার পিণ্ড পিটিয়ে তৈজস বানাত। এই অঞ্চলের ধাতু উৎপাদনের
বিশেষত্ব হল, সুন্দরতম আকার আর আঙ্গিকের কাঁসার ঘটি। কারিগরদের দাবি এই ঘটিটির
আঙ্গিকটির উদ্ভাবন তাদেরই।
এখানকার কারিগরেরা নিজেদের কর্মকার হিসেবে দাবি করেন আর এদের উপাধি রাউথ। রাউথ
হল নিচু শ্রেণীর রাজপুত। তাদের মতে তারা প্রখ্যাত রাজপুত রাজা রাণাপ্রতাপের সময়কার
কারিগর। এক সময় তারা কারিগর ছিল তাদের একাংশ আবার ব্যবসাদার হয়েছে।
বালি-দেওয়ানগঞ্জ যতদিন বন্দর হিসেবে কাজ করেছে ততদিন এই অঞ্চলের কারিগরদের
সুখ্যাতি এবং স্বনির্ভরতা গড়ে উঠেছিল। নদী শুকিয়ে যাওয়ার জন্যে তাদের একাংশ
বিষ্ণুপুর বা বাঁকুড়ার মত অঞ্চলে বাস করতে শুরু করে।
ধাতু কারিগরদের মধ্যে কর্মকার আর কংসবণিক ছাড়া কলকাতায় আরও একটি বংশপরম্পরায়
ধাতু উৎপাদনের জাতির সন্ধান পাওয়া যায়, তাদের উপাধি মন্ডল। তারা হিন্দু সমাজ
পিরামিডের নিচু জাতি রাজবংশীদের থেকে উদ্ভুত। বর্তমানে তারা বর্মন উপাধি নিয়েছে
যেটি ক্ষত্রিয়দের মধ্যে দ্যাখা যায়। তারা বাংলার এজটি গুরুত্বপূর্ণ ধাতু তৈজস এবং
পণ্য উৎপাদন অঞ্চল নবদ্বীপের অধিবাসী এবং সেখান থেকে তারা কলকাতায় এসেছে, এছাড়া
তারা তাদের অতীত সম্বন্ধে তারা কিছুই বলতে চায় না। রাজবংশীরা উত্তরের জাতি।
বাংলার অন্যান্য এলাকায় জুগি, কৈবর্ত, রজক ইত্যাদিরাও কোথাও কোথাও ধাতুর কাজ
করে থাকে।
No comments:
Post a Comment