একটি সর্বগ্রাসী দৃষ্টিভঙ্গী
একমাত্র গণতান্ত্রিক ভাবনাই আধুনিকতার এই দুই দলনকে প্রতিহত করতে পারে, যে
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হল মানবিক অধিকার। এবারে আমরা দেখি, আধুনিকতার সর্বগ্রাসী
মনোভাব দমনকরতে এই হাতিয়ারের কিভাবে ক্ষতিসাধন করা হয়েছে।
এর আগে আমরা দেখেছি জন্মগতভাবে একই গর্ভে আধুনিক বিজ্ঞান আর উন্নয়নের উদ্ভব
হয়েছে এবং উভয়েই প্রথম থেকেই মানুষ আর পরম্পরার শিল্পের ওপর খড়গহস্ত। আমরা আলোচনা
করেছি কি ভাবে নতুন জাতিরাষ্ট্র আকর্ষনীয় বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করে, তাদের অগ্রগতির
সজ্ঞা অনুযায়ী মানুষকে বদল করার চেষ্টায় উন্নয়ন প্রকল্পে নিবেদিতপ্রাণ হয়ে উঠেছে।
আধুনিক বিজ্ঞান/আধুনিক রাষ্ট্রের এই দুই চরিত্রই মানুষের স্বভাবিক অধিকারের
পরিপন্থী। প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান প্রকৃতি এবং পরম্পরার প্রযুক্তিকে অযোগ্য, নিকৃষ্ট
এবং ন্যুনতার প্রান্তিক মানক(marginal
value) হিসেবে দেগে দেয়। এই সুযোগে বড় পুঁজির শিল্প(পুঁজিবাদী
বা রাষ্ট্রবাদী উভয়েই) বিজ্ঞানের সরবরাহকরা কর্মপদ্ধতি বাস্তবায়িত করার উদ্যম নেয়।
মনে রাখতে হবে, শিল্প বিপ্লবের আগে পর্যন্ত, মানুষের ইতিহাসের জীবন রক্ষার জন্য
প্রযুক্তিক জ্ঞান ছিল বিকেন্দ্রিত এবং আমূল বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা। বাস্তবিক,
লক্ষ লক্ষ শিল্প এবং প্রযুক্তি বেঁচেছিল মূলত পারিপার্শ্বিক তাপ প্রয়োগ করে
সংগৃহীত জ্ঞান এবং মানুষের উভাবিত ধারণা, কাঁচামাল, ইঙ্গিতময়তার যৌথতায়। বহু ক্ষেত্রে
মানব প্রজাতির প্রাযুক্তিক বিপুল বৈচিত্র, প্রকৃতির জিনগত বৈচিত্রের সঙ্গে তুলনীয়।
দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি, মানবীয় স্বাভাবিক অবস্থা(human normality)কে নতুন করে
সংজ্ঞায়িত করা হল। যতক্ষণনা মানুষ আধুনিকতার কাছে মাথা নোয়াচ্ছে, ততক্ষণ তার মানবিক
বোধ নিয়ে কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়ার অধিকারটাও কেড়ে নেওয়া হল। তাদের অবমানুষ(deficient) হিসেবে ধরে নিয়ে
নতুন করে ছাঁচে ঢালা শুরু হল। এর আগে ভারত সরকারীর ঘোষিত বৈজ্ঞানিক নীতিমালাটির
উল্লেখ করেছি, সেখানে বলা হল, ভারতের বিপুল মানবসম্পদ দক্ষ এবং শিক্ষিত করলে
আধুনিক বিশ্বে তারা সম্পদ হয়ে উঠতে পারে(‘India’s
enormous resources of manpower can only become an asset in the modern world when trained or
educated’)। এই হয়ে ওঠার পদ্ধতিতে পড়ে তারা যদি কোন এটা বলশালী
কৃষ্টির ম্লান ভাঁড়(pale caricatures) হয়ে ওঠে, তাতেও তাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতিবৃদ্ধি হয় না। বিজ্ঞান
এবং তার বিশেষজ্ঞরা ঠিক করলেন কিভাবে মানুষকে ‘মানুষ’, শিক্ষিত, সংস্কৃত করে তোলা
যাবে, এবং তারাই ঠিক করে দেবে এই নব্য মানুষেরা কি কি আত্মীকরণ করবে।
প্রাথমিকভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের পক্ষে এই উদেশ্য পূরণ করা
খুব কঠিন কাজ হবে না ধরে নেওয়া হল। কেননা তার দাবি ছিল সে অতি দক্ষ এবং তার ব্যাখ্যা
শক্তিও বিপুল। সে বলেই দিল অতীতে মানুষ তার তত্ত্ব তথ্য বিশ্লেষণ করেছে, সে সবের
তুলনায় তার ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা অনেক গুণ বেশি, কারণ সে পক্ষপাত বিহীন এবং
বিষয়মুখী। এই বিষয়মুখিতার সঙ্গে সহজেই জুড়ে দেওয়া গেল সাম্য আর গণতন্ত্রকে কেননা
অপক্ষপাত সক্কলের জন্য উপকারী। (উদাহরণস্বরূপ যে কোন রাজকীয় প্রশাসনকে কুখ্যাতবলে
দেওয়া যায়)। তার ফলে আধুনিক বিজ্ঞান আধুনিক গণতন্ত্রের জন্য সর্বরোগহর।
ইঙ্গিতেই বুঝিয়ে দেওয়া হল, যা ‘অ-বৈজ্ঞানিক’ তা মূল্যহীন, বিষয়ী এবং
নির্বিচারে তা প্রান্তিক মান বিশিষ্ট, এবং জননীতি তৈরি করতে এগুলিকে ভিত্তি ধরা
চলে না।
সপ্তদশ শতকের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব চিন্তার জগতে চিন্তার বিপ্লব। এই বিপ্লব আমাদের
মাথায় ঢুকয়ে ছাড়ল, মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম মানুষ জ্ঞানকে শাস্ত্রের বাইরে
বের করে এনে, আলাদাভাবে জ্ঞান হিসেবে দেখার, বোঝার যোগ্যতা অর্জন করল। এবং এই বৈজ্ঞানিক
পদ্ধতিতে জ্ঞানার্জনের পদ্ধতিটা এতই বিশ্বাসযোগ্য যে, যে জ্ঞান আর্জিত হল নতুন করে,
তা বাস্তবিকভাবে অবিনিময়যোগ্য (non-negotiable) বলে দেওয়া হল। আদতে এই দাবি সর্বপ্রথম মানুষের স্বাভাবিক
অধিকারের ওপর আঘাত হানল।
(ক্রমশঃ)
উলফগাং শ্যাকস সম্পাদিত দ্য ডেভেলাপমেন্ট ডিক্সনারি, আ গাইড টু নলেজ এজ পাওয়ার
থেকে
No comments:
Post a Comment