বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘের কথা
ওয়াপাগ, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ এবং কলাবতী মুদ্রার পক্ষে সম্প্রতি ওঠা বিবাদে তার ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা আর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার অবস্থান বিষয়ে কিছু কথা বলা দরকার।
ব্রিটিশদের ভারতীয় সভ্যতা ধ্বংসকর্মে বামেরা মুক্ত কচ্ছ হয়ে সমর্থন করেছে – যে কাজের সমর্থন তাঁরা আজও খুঁজে নেন কার্ল মার্ক্সের ভারত সভ্যতা ধ্বংস এবং তার পুনর্গঠনের কাজের মধ্যে থেকে – শিল্পবিপ্লবের পরিকাঠামো অবশ্যম্ভাবী ধরে নিয়ে - এবং এঙ্গেলসএর এই উক্তির মধ্যে দিয়ে - ব্রিটিশেরা উন্নত প্রযুক্তি এনেছিল বলেই তাঁরা ভারতকে উপনিবেশে পরিণত করেছিল - যার থেকে বড় মিথ্যা আর দুটো হয় না। আজও পশ্চিম প্রযুক্তির জোরে কোনো যুদ্ধ জেতে নি - সেদিনের পলাশি চক্রান্ত থেকে ভিয়েতনাম হয়ে আজকের ইরাক পর্যন্ত - প্রযুক্তি নির্ভর যুদ্ধ করতে গিয়ে তারা নাস্তানাবুদ হয়েছে। সেদিনের ইওরোপ আর আজকের আমেরিকা সরাসরি নির্ভর করেছে জোনস, উইলসন, মিল, মেকলে আর তার ষড়ু ট্রেভলিয়ন আর ম্যাক্সমুলরের বিকাশ করা উপনিবেশবাদের তত্ত্বের ওপর। যার রেশ আজও ভারতে চলছে।
এদেশে শিল্প বিপ্লবের বীজ রোপণ করার ক্ষেত্র হিসেবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ভারত উপনিবেশের এই ধ্বংস প্রক্রিয়াকে ভারতের ইংরেজি শিক্ষিত জনগণ আজও দুহাত তুলে সমর্থন করে আসছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে এই দুই সংগঠন বিশ্বাস করে ভারতের মাটি, অর্থনীতি, সমাজ, মানুষের মানসিকতা তখনও শিল্পবিপ্লবের পরিকাঠামো তৈরির অনুকূল ছিল না আজও নেই। তার উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন – বিকেন্দ্রিত, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উৎপাদন, বিতরণ ব্যবস্থা, বিকেন্দ্রিত শিক্ষা ব্যবস্থা নির্ভর এক দেশ - যেখানে পুঁজির লাভ বেঁটে যেত সারা সমাজে, শিক্ষাও পেত সক্কলে। যে দিন থেকে তাকে তার কয়েক হাজার বছরের পরীক্ষিত উৎপাদন ব্যবস্থা ভেঙ্গে শিল্পবিপ্লবীয় উৎপাদন ব্যবস্থায় ঢালার চেষ্টা হয়েছে, এবং অর্থনীতি বিকাশের নজর কৃষি থেকে শিল্পে পড়েছে - কৃষি অর্থনীতিকে রাজস্ব নিংড়োনোর কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেদিন থেকেই ভারতের অর্থনীতি, শিক্ষার অধোগতির শুরু।
১৭৫০এ বিশ্বের ২৫ শতাংশএর বেশি উৎপাদন অংশ ছিল যে দেশের, বাংলার ছিল ৬, তারা পলাশির কয়েক দশকের মধ্যে প্রায় শূন্যে নেমে এল। এই কাজে সব থেকে ক্ষতি হল ভারতের গ্রামীন জনগনে্ বিশ্ববাজার থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করা হল। লাভ হল ইংরেজি শিক্ষিত শহুরে পাশ্চাত্যপন্থী উচ্চবর্ণের, যারা এই শিল্পবিপ্লবীয় পরিকাঠামো তৈরি করতে উপনিবেশকে সহায়তা করল, স্বাধীনতার পর আজও করে চলেছে, তার উপহার পেয়ে চলেছে - চাকরি, ব্যবসা আর দালালির সহায়তা পেয়ে। সম্প্রতি স্টার্টআপে উদ্যোগীদের রাষ্ট্রের সাহায্যদানের ঘোষণা এই প্রবণতার বিস্তৃত উদাহরণ।
যে দেশের বিকাশে শুদ্ররাই ছিল প্রাণভোমরা(১৮৩৬এর এডামের সমীক্ষা বলছে বাংলা-বিহারের এক লক্ষ ছাপান্ন হাজার গ্রামের এক লক্ষ পাঠাশালায় ১৫ শতাংশ পড়ুয়া এবং শিক্ষক উচ্চবর্ণের - বাকি শুদ্র এবং অন্যান্য ধর্মের। পাঠ দান হত দেশি ভাষায়। একমাত্র এডামই ভারতের পাঠশালাগুলিতে পাঠদানের কাজে দেশি ভাষা ব্যবহারের নিদান দিয়েছিলেন। ঠিক সেইজন্য স্বাধীন ভারতের কোনো শিক্ষা-সমীক্ষাতেই এডামের সমীক্ষাকে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না - দক্ষিণ ভারতে তা আরও বেশি), সেদেশে সাম্রাজ্যের সহায়তায় মধ্যবিত্তের উত্থানে, দেশের বিকাশের কাজে শুদ্ররা হয়ে গেল নিতান্ত দারিদ্র্য পাদটিকা মাত্র – রাষ্ট্র প্রতিপালনে উচ্চবিত্ত ইংরেজি শিক্ষির মধ্যবিত্তরা হয়ে গেল কেন্দ্রবিন্দু। তাই আজও পাশ্চাত্যপন্থী মধ্যবিত্ত উপনিবেশ বিরোধী কোন মতবাদ শুনলেই রে রে করে তেড়ে ওঠেন। এ নিয়ে আমাদের তাত্ত্বিক অবস্থান আমরা স্পষ্ট করে দিয়েছি ১৭ তম পরম পত্রিকায় যেখানে আমরা উপনিবেশ এবং ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্ত সম্পর্কে মোটামুটি বিশদে তাত্ত্বিক আলোচনা করেছি।
বাংলায় পরম্পরার উৎপাদন-বিতরণ ব্যবস্থা এবং দেশিয় জ্ঞানচর্চাকে নতুন করে আলোচনায় আনতে এবং আড়াইশ বছরের ঔপনিবেশিকতাবাদের শেকড় উতপাটনে কাজ করে চলেছে এই ওয়াপাগ আর তাঁর সদস্য সংগঠনগুলি। এই কাজে মধ্যবিত্ত সমাজের বেশ কয়েকশ বছরের সযত্ন লালিত ধারণা উতপাটিত হচ্ছে। সেই ধারণাগুলি নিয়ে নতুন আলোচনায় উঠে আসছে নানান ধরণের না-বলা/কম-বলা তথ্যাবলী। আমাদের অবস্থান নিয়ে আমরা মাঝে মাঝেই লেখার চেষ্টা করি এবং সেই ভাবনা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।
তার একটা হাতিয়ার আমাদের ছাপা পত্রিকা – পরম এবং ফেসবুক আর ব্লগ। সেই খোঁজে বেশ কিছু আস্বস্তিকর তথ্য উঠে আসছে– বিশেষ করে ঔপনিবেশিক মধ্যবিত্তের স্বার্থের প্রতিকূল সেই সব তথ্য। আজও আমরা মনে করি দেশজ প্রযুক্তিকে নথি করণের যে কাজটি আমরা করছি, তার মূল প্রণোদন হল, সরাসরি উপনিবেশবাদের বিরোধিতা। সেগুলি আপনাদের বিবেচনার জন্য উপস্থিত করা গেল পরের প্রকাশনাগুলিতে।
No comments:
Post a Comment