ওয়াপাগ, বঙ্গীয় পারম্পরিক কারু ও বস্ত্র শিল্পী সংঘ আর কলাবতী মুদ্রার পক্ষে করা বিভিন্ন পোস্ট নিয়ে বিভ্রান্তি চলছে। তাঁদের পক্ষে কতকগুলো কথা পরিষ্কার করে বলা দরকার, না হলে ভবিষ্যতে ভুল বোঝাবুঝি হবেই।
মতান্তর হোক। আলোচনা চলুক।
১) প্রাচ্যবিদ্যা যদি শুধু সংস্কৃত ভাষা ভিত্তিক ভারতীয়/এশিয় শহুরে জ্ঞানচর্চা হয়, তাহলে সেই জ্ঞানচর্চা নিয়ে অন্তত আমাদের উতসাহ কম - এবং সেই কাজে আমাদের যোগ্যতা খুব কম। এ বিষয় নিয়ে এদেশের, পশ্চিমের বহু জ্ঞানী কাজ করে চলেছেন, তা আমাদের যতই অপছন্দ হোক না কেন। মাঝে মাঝে দ'য়ে পড়ে মন্তব্য করি মাত্র।
২) ব্রিটিশ পূর্ব সময়ে সংস্কৃত চর্চা ছাড়াও এদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে সেই অঞ্চলের উপযোগী(বিন্দুমাত্র আন্তর্জাতিক নয়), সেই অঞ্চলের ভাষায় জ্ঞানচর্চার ইতিহাস ছিল। তা নিয়ে আমাদের উতসাহ।
৩) এদেশের গ্রাম্য জ্ঞানচর্চা, যা নিয়ে আমাদের উতসাহ - এগুলি ছিল বিকেন্দ্রীভূত - এর সঙ্গে নালন্দা বা, তক্ষশীলার মত শহুরে, রাষ্ট্র পোষিত, বৌদ্ধ দর্শন(ধর্ম) পোষিত বিদ্যাচর্চা কেন্দ্র - যার গালভরা পশ্চিমি নাম ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা আশোক প্রবর্তিত হাসপাতালের মত কেন্দ্রীভূত সেবা নিয়ে উতসাহ কম - তা নিয়ে বহু কাজও হয়েছে, হচ্ছে, হবেও - আমাদের উতসাহ গ্রামে যেভাবে আঞ্চলিক উৎপাদন, বিতরণ, চিকিৎসা, আঞ্চলিক উপাদানে নিদান দেওয়া হয় বা গ্রামে ভিষগ বা দাইমারা যেভাবে পীড়িতদের বাড়ি গিয়ে তাঁদের সেবা দিয়ে আসেন আজও, বা বাংলায় ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের বা হেস্টিংস, ক্লাইভ বা কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের চলমান লুঠের পরেও বাংলা এবং বিহারের এক লাখ ছাপান্ন হাজার গ্রামে সেই অঞ্চলের ভাষায় এক লাখ বিকেন্দ্রীভূত পাঠশালার আয়োজনের ইতিহাস পাওয়া যায় সেগুলোর ব্যবস্থাপনা, ইতিহাস নিয়ে - বা তাঁতি, চাষী বা নাবিকদের চর্চায় কলণবিদ্যা কি ছিল তাই নিয়ে।
৪) সাম্রাজ্যবাদী ইওরোপিয়রা ভারতে সাম্রাজ্যবিস্তারে আসার পর ভারত-ইওরোপিয় বাণিজ্যের ঢাল ইওরোপের দিকে ঢলাতে চেষ্টা করতে করতে যে প্রাচ্যবিদ্যা শুরু করেন তা খুবই খণ্ডিত এবং উদ্দেশ্যপূর্ণ, একদেশদর্শী দৃষ্টি সম্পন্ন। সাম্রাজ্যবাদী প্রাচ্যবিদ্যার মূল কথা হল, 'ভারত(জ্ঞানচরচা) অতীতে বহুরঙ্গীন ছিল, বর্তমানে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমরা এসেছি সেই নষ্ট দুর্মূল্য জ্ঞানগুলি উদ্ধার করতে। আমরাই তাদের উদ্ধার কর্তা।' ফলে পলাশীর পর থেকে ব্রিটিশ ইন্ডোলজিস্টদের রমরমা - যারা তাঁদের মত করে ভারতের জ্ঞানচর্চা্র উদ্ধার বিষয়ে তাঁদের জ্ঞানচর্চামত করে ওষুধ-পালা দিয়ে যান - ভারত(আমাদের আগ্রহ মূলত বাংলা আর খুব বেশি হলে গ্রাম ভারত) বহুকাল ধরে নানান বহিরাগত আক্রমন সয়েছে - ধ্যান ধারণা সয়েছে। কয়েক হাজার বছরের তার বিকশিত জ্ঞান - সে কেন্দ্রীভূতই হোক বা বিকেন্দ্রীভূতই হোক, নিজের মত করে রক্ষা করেছে। পাশ্চাত্য বলের প্রভাবে, আমরা মনে করছি সেই জ্ঞানের কাঠামো, ধারকগুলি ভেঙ্গে পড়েছে - কিছুটাতো হয়েইছে, তা বলা হয় নি - জোর করে মসলিন শিল্প নষ্ট করে দিয়ে বলা হয়েছে ম্যাঞ্চেষ্টারের উৎপাদনের এবং প্রযুক্তির প্রাবল্যে তা ভেঙ্গে পড়েছে বা পাশ্চাত্য কেন্দ্রীভূত দেশের শেকড় বিচ্ছিন্ন, পশ্চিমের কেন্দ্রিভূত শিল্পের আর ভারতে সরকার চালাতে শ্রমিক তৈরি করতে কর্পোরেট শিক্ষার প্রসার ঘটেছে বিদ্যাসাগর মশাইদের অতি উদ্যমে - সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় - ভারতজোড়া বিস্তৃত গ্রামীন অকেন্দ্রীভূত শিক্ষা ব্যবস্থাধ্বংস করে - তবুও এত ধ্বংস ক্রিয়ার মধ্যে বহুকিছু জ্ঞানচর্চা টিকে রয়েছে তাও অমূল্য। সেদিকে সাম্রাজ্যবাদী ইওরোপের বা ইওরোপপন্থী বন্ধুদের দৃষ্টি পড়ে নি খুব একটা। যা চেষ্টা হয়েছে তা হল, পশ্চিমের লুঠেরা খুনি জ্ঞানচর্চার চশমায় ভারতীয়/কারিগরি জ্ঞানচর্চাকে দেখা। এ নিয়ে অনেক ফেবু পোস্ট লিখেছি আমরা।
৫) আর বহু পণ্ডিত মানুষ পাশ্চাত্যবিদ্যার খামতি বিষয়ে যদি আমাদের মত চান। সে বিষয়ে বলি - আমাদের বিন্দুমাত্র এ বিষয়ে উতসাহ নেই। বিগত আড়াইশ বছরে ইওরোপ বাংলা, ভারত, এশিয়া থেকে যে জ্ঞান, সম্পদ লুটে চুষে নিয়ে গিয়েছে্(আজও বিশ্বায়নের নামে পাতি লুট চলছে ইওরোপ-আর ইওরোপের তৈরি করা আমেরিকার), তাঁর সুদেই তাঁদের চলছে - তার আসলে এখনও হাত পড়ে নি - সেই উদবৃত্তে তাঁরা ভারতীয়দের পাশ্চাত্যবিদ্যায় উতসাহী করে তুলেছে - সেই চর্চায় যদি আজ ভাটার টান আসে তাহলে বুঝতে হবে শুধু ভাতা দিয়ে জ্ঞানচর্চা কেনা যায় না - তাঁর জন্য মার্ক্স কথিত সভ্যতার ষড়ৈশ্বর্যের ভিত্তিভূমি অনুভব করার প্রয়োজন হয় - দুঃখের কথা তা ইওরোপের নেই আছে এই আলসে, হীনমন্যী ও পরশ্রীকাতর এশিয়া আফ্রিকা আর লাতিন আমেরিকার।
অলমিতি।
জয় গুরু!
জয় বাংলা!
No comments:
Post a Comment