জ্ঞানচর্চার প্রবাহের একটা গুরুত্বপূর্ন উদাহরণ পাচ্ছি চন্দ্র ভানের লেখায় শাহ জাহান এবং আওরঙ্গজেবের সময়ে গুরুত্বপূর্ন পদাধিকারী নুর আল দিন মহম্মদ আবদ আল্লা সিরাজির আলোচনায়। তিনি শুধু দুই সম্রাটের সময়ের উচ্চ পদাধিকারিই ছিলেন না, ছিলেন আকবরের সভাসদ আবুল ফজল এবং আবুল ফৈজ ফৈজির বংশোদ্ভুত। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের ইতিহাসে বিপুল অবদান পেশ করেছেন। সুস্থ থাকার শিল্প নিয়ে তিনি বহু শাস্ত্র রচনা করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখ্য হল ইলাজত দারা শুকোহি(ওরফে টিব্বি দারা শুকোহি, ১৬৪৬ সনে)। এই বইতে তিনি য়ুনানি এবং ভারতীয় চিকিৎসা শাস্ত্রের যতটুকু জ্ঞান ছিল, সেগুলি সঙ্কলিত করেছেন জাহানারার দুর্ঘটনার দু বছর পর এবং বইটি তিনি সাম্রাজ্ঞীর ভাই দারা শুকোকে উতসর্গ করেন।
নুর আল দিনএর অন্য পৃষ্ঠপোষকও ছিল। তার লেখা আরবি আর পারসি চিকিৎসাশাস্ত্রীয় লব্জগুলি নিয়ে অভিধান কিতাস অলাটিব্বা (চিকিৎসকের মাণদণ্ড, সংকলিত ১৬৩০-৩১)কে উতসর্গ করেন মুঘল আমলা আমন আল্লা খানকে(মৃ ১৬৩৭)। আমল আল্লা খান নিজে চিকিৎসাশাস্ত্রবিদ ছিলেন এবং ঔষধবিজ্ঞান বিষয়ে অন্তত একটি পুস্তক রচক এবং চৌদ্দশতকের একটি সংস্কৃত চিকিৎসা শাস্ত্র মদনাবিনোদের ফার্সি অনুবাদক। এছাড়াও তিনি রোগনির্ণয় এবং নিদানবিদ্যা বিষয়ে আনিস অল মুয়ালিজিম (চিকিৎসক সাথী) সঙ্কলকও এবং স্বাস্থ্য বিধির প্রয়োজনীয়তা নিয়েও শাবাবই সিত্তা রশিদি(ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যবিধি) রচনা করেন। তবে ভারতীয় বিজ্ঞানের ইতিহাসকার Fabrizio Spezialeর মতে তিনি প্রখ্যাত হয়ে থাকবেন আলফাজ আল আদ্বিয়া(চিকিৎসাবিদ্যার লব্জগুলি, ১৬২৮-২৯)। বইটিতে ১৪৪১টি ভারতীয় ওষুধএর উল্লেখ আছে এবং এটি শাহ জাহানের প্রতি উৎসর্গীকৃত। Speziale জানাচ্ছেন ১৭৯৩ সালে এই বইটি ফোর্ট উইলিয়ামের হাসপাতাল কমিটির জন্য ফ্রান্সিস গ্ল্যাডউইন অনুবাদ করেন। উনবিংশ শতকে এর সাতটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়।
আলোচনায় পরিষ্কার মুঘল আমলকে ধর্মান্ধ ইত্যাদি বিশেষণে দাগিয়ে দিতে দেশি বিদেশি গবেষকেরা যে উতসাহে পরিশ্রম করেছেন এবং প্রচার পেয়েছেন দেশিয় এবং পশ্চিমি প্রচারমাধ্যমে, তার তুলনায় খুব কম পরিশ্রম এবং বুদ্ধিবৃত্তি ব্যয় হয়েছে এই সময়ের বৌদ্ধিক শাস্ত্র বিষয়ে গবেষণার আলোচনায়। মুঘল সম্রাট এবং অভিজাতরা কিন্তু এই বৌদ্ধিক পরিবেশ জিইয়ে রেখেছিলেন তাঁদের সময়ে এবং সেই জন্য মহম্মদ দাউদ বিখ্যাত হন। মনে রাখতে হবে চন্দ্রভান কিন্তু তাঁকে, তাঁর সময়ের গ্যালেন হিসেবে চিহ্নিত করছেন না, তিনি পুরনো মানসিকতার মানুষ বলে নয় বরং বলছেন, এমন কিছু নবতম পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন, যা তার সময়ে সুলতানতের চক্ষুকে ভাল করে তুলেছিল(access to novel remedies and wondrous therapies that finally cured that light in the eye of the sultanate and empire)।
আরিফ চ্যালা নামে এক অজ্ঞাতকুলশীল চাপরাশি যিনি পরে মহম্মদ দাউদ নামে বিখ্যাত হবেন, রাজ্ঞীর ঘা সারাবার জন্য নতুন ধরণের পট্টি(bandages) আবিষ্কার করেন। এই কাজের জন্য তাঁকে উপহারে ভরিয়ে দেওয়া হয়। সম্রাটের হাতিশাল থেকে হাতি, মনসব পদ দেওয়া হয়। এছাড়াও সারা রাজ্য জুড়ে দানের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়, রান্নাশাল ক্ষুধার্থদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। বন্দী মুক্তি ঘটে। প্রচুর খেরাজ সম্পত্তি উপহার দেওয়া হয় কিন্তু চন্দ্র ভান ব্যঙ্গ করে বলছেন এই কাজ আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় বেশ দেরিও হয়।
No comments:
Post a Comment