অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
ফার্গুসন তোলা ছবিগুলি বিশদে লক্ষ্য করে এই স্থাপত্যকে তিন
ভাগে ভাগ করলেন। একটি সাঁচির মত মূল স্থাপত্য প্রাসাদটির বাইরের পাঁচিলকে সজ্জা
হিসেবে অনুকরণে, যা আমরা ম্যাকেঞ্জির আঁকায় বুঝতে পারি। আরেকটা সেট বাছলেন, সেটা
ছোট কিন্তু নান্দনিকতায় ঋদ্ধ যা ঘেরা পাঁচিলের মধ্যে ছিল বিশ্বাস করতেন ফারগুসন। এগুলিকে তিনি এলেবেলে বলে বললেন এগুলির কোন
স্থাপত্য শৈলী নেয় তাই সেগুলো যেখানে সেখানে বসানো যায়। এরপর থেকে ফার্গুসনের
অমরাবতী নিয়ে উৎসাহ বাড়বে এগুলির টুকরো টাকরা দেখে তিনি বৌদ্ধিকভাবে এটা নিয়ে কাজ
করতে উৎসাহী হয়ে পড়বেন। এই অংশগুলি নিয়ে ভারতের ইতিহাস বলতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন।
এগুলি থেকে ভারতের মানুষ, তাদের পরিধেয়, জীবজন্তু, বাড়িঘরদোর, সিম্বল আলোচনা করার
অদ্যম্য উৎসাহ জাগল ফার্গুসনের মনে।
প্রদর্শনীর শুরুর আগে১৮৬৫ সালের ২১ ডিসেম্বর তিনি ছবিগুলো
নিয়ে সোসাইটি অব আর্টসের সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। পৌরোহিত্য করলেন টমাস ফিলিপ্স, ভারত
রাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি। উপস্থিত ছিলেন প্রদর্শনী সঙ্গঠক কোল নিজে। সেখানে
তিনি অন স্টাডি অব ইন্ডিয়ান আর্কিটেকচার নিয়ে বক্তৃতা দিলেন। ভারতীয় স্থাপত্য কলার
ইতিহাস ও নীতিসমূহের বিশদ বিবরণ নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা না দিয়ে কেন ভারতীয়
স্থাপত্য আলোচনায় জাতিতত্ত্ব(এথনোলজি) এবং ধর্ম বোঝার ক্ষেত্রে জরুরি, এবং
ইংলন্ডের স্থাপত্য বুঝতে কেন ভারতীয় স্থাপত্য বুঝতে হবে, সেটা তিনি সেই বক্তৃতায়
বলেন। তার বক্তৃতা তিনি শুরু করলেন ভারতের জাতিগত(রেসিয়াল) এবং
জাতিতাত্ত্বিক(এথনোলজিক্যাল) ইতিহাস নিয়ে। তিনি ভারতের পুরোনো সময় মোটামুটি
যথাযথভাবে তুলে ধরেন। গঙ্গা অববাহিকার ভিল গোন্দ আর কোন আদিবাসীরা গোটা উত্তরভারতে
রাজত্ব করত। এদের হারিয়ে দেয় সংস্কৃতভাষী বহিরাগত আর্যরা দু হাজার বছর আগে। এই
সংস্কৃতভাষীরাই ভারতের কৃষ্টি ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। কিন্তু তারা ভাল স্থপতি ছিল
না। অন্যান্য বিদেশিদের মতই ভারতের শক্তিহীন করে দেওয়া জলবায়ু আর পরিবেশে তাদের
বৌদ্ধিক ক্ষমতা লোপ পেয়ে যায়। আরও ক্ষতি হয় স্থানীয়দের সঙ্গে রক্তের মিশ্রণে। আর্যদের
ক্ষমতা কমে যাওয়ার পরেই বুদ্ধের মত ধর্মীয় নেতার আবির্ভাব হয়, যিনি মানুষকে নতুন
শুদ্ধ ধর্মের পথ দেখিয়েছিলেন। তারপরেই ভারত অতল গহ্বরে ডুবে যেতে থাকে –
মূর্তিপুজোর রমরমা শুরু হয় আর ভারতীয়রা দুর্নীতিপরায়ন হয়ে প’ড়ে নিজেদের উজ্জ্বল
অতীতের কবরে নিমজ্জমান হয়। বৌদ্ধধর্মের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে আবারও উত্তরাঞ্চল
থেকে দ্রাবিড় জাতি ভারত আক্রমন করে নিম্ন সিন্ধু সভ্যতায় বসতি স্থাপন করে। তারা
গুজরাট হয়ে দক্ষিণভারতে বসতি ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই জাতি বড় স্থাপতি কিন্তু উত্তর ভারতীয়দের
থেকে আলাদা চরিত্রের। ফারগুসন বললেন খ্রিষ্ট আবির্ভাবের দুই তিন শতাব্দ পূর্বে আবারও
একটা জাতি ভারত আক্রমন করে, যাদের নাম তিনি বলেন নি, কিন্তু তারা রাজপুতানা আর
গুজরাটে বসতি স্থাপন করে। কিছু মহীশূরে চলে যায়, অন্যন্যরা আগরা দিল্লি এবং
উত্তরভারতের অন্যান্য অঞ্চলে বসতিস্থাপন করে। চতুর্থ আক্রমন হল মুসলমানেদের। এবং
পঞ্চম যে সভ্যতা ভারত জয় করল তারা হল আমরা ইওরোপিয়রা।
ফারগুসন বললেন স্থাপত্যের আলোচনায় ভারত যে ভূমির কোন লিখিত
ইতিহাসকে বিশ্বাস করা যায় না, তার যথার্থ বৈজ্ঞানিক ইতিহাস লেখা যাবে। কোন লেখ বা
মুদ্রায় যখন কোন রাজার উল্লেখ পাওয়া যাবে, তখনই সেই রাজার সময় নির্ধারণ করা উচিত,
এবং সেই রাজা এবং তার পারিষদবর্গ কিভাবে সেই সময় সভ্যতা গড়ে তুলেছিল, সেটা জানা
যায়।
No comments:
Post a Comment