অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
যে নির্দিষ্ট বস্ত্রখণ্ডগুলির মার্ফত ক্ষমতার অংশ হস্তান্তর হয় তাকে খেলাত বলে। ব্রিটিশ সংজ্ঞায় খেলাত হল রোব অব অনার আর ফরাসী ভাষায় ক্যাপ আ পিয়ে বা মাথা থেকে পা। মুঘল ভারতে খেলাত দেওয়া হত শ্রেণী ভিত্তি করে তিন, পাঁচ ও সাত অংশে। সাত খানা খেলাতে থাকত একটা পাগড়ি, একটি জোব্বা (কাবা), আর লম্বা জামার ওপরে কোট, একটা আঁটোসাঁটো কোট(আলখিলাক), একটি কমরবন্ধ, পাজামা, আরও একটা জামা এবং একটা উত্তরীয়। এই কাপড়ের সঙ্গে আরও অন্যান্য দ্রব্যও থাকত।
সব থেকে শক্তিশালী খিলাত হত সেইগুলো যেগুলি সম্রাট নিজে যে সব জামা বা আলখাল্লার মত পরিধেয় পরিধান করতেন এবং বিভিন্ন সময়ে তিনি সেগুলির অংশ নিয়ে তার প্রতিনিধি বা প্রজাকে দান করতেন সাম্মানিক হিসেবে। এরপরের গুরুত্বপূর্নতম বস্তুটি ছিল তার পাগড়ি এবং তার দেহের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্যান্য গয়না বিশেষ।
ভারতীয় সমাজে সব ধরণের সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে মাথা, হাত আর পা যুক্ত থাকত। আকবরের দরবারে সম্মান জানানোর প্রথা ছিল আভূমি প্রণিপাত হওয়া বা সেলাম জানানো – এগুলি কুর্ণিশ, তসলিম এবং সিজদা তিন ভাগে বিভক্ত। আবুল ফজল লিখছেন, সম্রাট তার প্রজ্ঞান প্রয়োগ করে, জনগণের কাছ থেকে কি ভাবে সম্মান অর্জন করবেন, তার নানান তারিকা উদ্ভাবন করেছিলেন ... মহামহিম(আকবর)এর নির্দেশ ছিল, মাথা নামিয়ে(প্রায় আভূমি) ডান হাতের তোলাটা কপালে ঠেকানো... একে বলে কুর্নিশ, এবং এটা জ্ঞাপিত হয় যে সম্মান দেখানো ব্যক্তি তার মাথাটি(যেটা চেতনা আর মনের অধিষ্ঠান)তে হাতের নম্রতাকে স্পর্শ করে, দরবারে উপস্থিত করানো এবং সম্রাটের যে কোন কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আর্জি জানান।
তসলিম হল বাঁহাতের পৃষ্ঠভূমি মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে আনন্দের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে দেহটাকে খাড়া করতে থাকা যতক্ষণনা শরীরটা সোজা হচ্ছে।
সিজদা হল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আকবরের দরবারে গোঁড়া ধর্মভীরু মুসলমানেরা যেভাবে প্রার্থনা করতেন। আকবরের নির্দেশ ছিল এটি তার সামনে ব্যক্তিগতভাবে করতে হবে জনসমক্ষে নয়। তবে অন্যান্য সম্রাটের সময়েও এটি চলে এসেছে।
আবুল ফজল বলছেন দরবারে যে মানুষটি সম্মান জানাচ্ছেন, তিনি আদতে নিজেকে সঁপে দেওয়ারই কাজ করছেন, তার মাথা মুঘলদের কাছে উপহার দিচ্ছেন। যুদ্ধে আত্মতোতসর্গ ছিল আক্ষরিক। সম্রাট আকবরের সময়ে আঁকা একটি মুঘল চিত্রশৈলীতে দেখতে পাই তার এক যোদ্ধা তার শত্রুপক্ষকে নিয়ে এসে সম্রাটের হাতির পায়ের কাছে জড়ো করে রাখছে। পরাজিত শত্রুদের কারোর মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই, পাগড়িও নেই, মাথাগুলি নামানো, তাদেরকে বিজিতর সামনে আনা হয়েছে।
অষ্টাদশ এবং নবম শতকে কোন ভারতীয় যদি তার শিরস্ত্রান কারোর পায়ের কাছে রাখত, সেটা তার পরাজয় বা আত্মসমর্পন বলেই গণ্য হত। এই আত্মসমর্পণের চিত্রটা রূপকশোভিতভাবে বাক্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতে ভ্রমনে আসা ব্রিটিশদের জন্যে লিখত নির্দেশিকা পুস্তকে লেখা থাকত কোন হিন্দু আর মুসলমানের পাগড়িতে হাত না দিতে, কেননা সেটি অপমান হিসেবে গণ্য হত।
১৮৪০ সালে ব্রিটিশেরা সিন্ধ জয় করে। সেই অঞ্চলটি মুসলমান জমিদারেরা ছিল যাদের কাছে পাগড়িই স্বাধিকারের সমান ছিল। ফারসি আর সিন্ধ ভাষায় দক্ষ এক কোম্পানি কর্মচারী ই বি ইস্টউইক পাগড়ির উপযোগিতা বিষয়ে বিশদে লিখছেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড এলিনবরো জেনারেল নেপিয়ারকে কোন এক বিশেষ শাসককে সমর্থন এবং তার পাগড়ি বিষয়ে লিখছেন, আই হ্যাভ লিটল ডাউট ওয়ান্স এস্টাব্লিশড ইন দ্য পজেশন অপব টার্বান... আলি মুরাদ উইল বি এবল টু এস্টাবলিশ দ্য মোর ন্যাচুর্যাবল এন্ড রিজোনেবল লাইন অব সাক্সেশন টু দ্য টার্বান, এন্ড ক্লোদ দ্য মেজার উইথ দ্য ফার্মনেস অব লিগালিটি।
মধ্য ইওরোপে যেমন শিরস্ত্রানের একটা বড় ভূমিকা ছিল, তেমনি ভারতের মুঘল শাসকেরাও পাগড়ি আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা গয়নাগুলির সঙ্গে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর চরিত্র জুড়ে ছিল। পাগড়ির সঙ্গে জুড়ে থাকা গয়না যেমন কালঘি – সারস বা ময়ূরের পালকের সঙ্গে জুড়ে থাকা রত্নর গুরুত্ব বিপুল ছিল। এইটা সর্বোচ্চ অভিজাতদের দেওয়া হত। জিঘা ছিল সোনায় তৈরি চাঙ্গড়ের ওপর কয়েকটা রত্ন বসানো তার সঙ্গে যুক্ত থাকত ময়ূরের পালক। সরপেঁচ বা সরবন্দ হল পাগড়িতে সেলাই করা সোনা বা রূপোর সূক্ষ্ম তারের কাজের ওপরে রত্নের সমাহার বসানো। পাগড়ির ওপর রত্নের কাজ করা মুক্তো শভিত উষ্ণীষ জড়িয়ে দেওয়া হত। মধ্যযুগের হিন্দু ঐতিহ্যে রাজারা বিশ্ব আর তার উতপাদনের মালিক। মহাকাশীয় বিবরণসূত্রে বলতে পারি পৃথিবীর সারমর্ম হল রত্নরাজি, এবং এগুলি খাঁটি ঘণীভূত এবং পবিত্র বস্তু। ফলে কাপড়, পাগড়ি এবং সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে থাকা রত্নরাজি আদতে বিশ্বের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
বস্ত্র এবং কর্তৃত্বের সংবিধান
যে নির্দিষ্ট বস্ত্রখণ্ডগুলির মার্ফত ক্ষমতার অংশ হস্তান্তর হয় তাকে খেলাত বলে। ব্রিটিশ সংজ্ঞায় খেলাত হল রোব অব অনার আর ফরাসী ভাষায় ক্যাপ আ পিয়ে বা মাথা থেকে পা। মুঘল ভারতে খেলাত দেওয়া হত শ্রেণী ভিত্তি করে তিন, পাঁচ ও সাত অংশে। সাত খানা খেলাতে থাকত একটা পাগড়ি, একটি জোব্বা (কাবা), আর লম্বা জামার ওপরে কোট, একটা আঁটোসাঁটো কোট(আলখিলাক), একটি কমরবন্ধ, পাজামা, আরও একটা জামা এবং একটা উত্তরীয়। এই কাপড়ের সঙ্গে আরও অন্যান্য দ্রব্যও থাকত।
সব থেকে শক্তিশালী খিলাত হত সেইগুলো যেগুলি সম্রাট নিজে যে সব জামা বা আলখাল্লার মত পরিধেয় পরিধান করতেন এবং বিভিন্ন সময়ে তিনি সেগুলির অংশ নিয়ে তার প্রতিনিধি বা প্রজাকে দান করতেন সাম্মানিক হিসেবে। এরপরের গুরুত্বপূর্নতম বস্তুটি ছিল তার পাগড়ি এবং তার দেহের সঙ্গে জুড়ে থাকা অন্যান্য গয়না বিশেষ।
ভারতীয় সমাজে সব ধরণের সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে মাথা, হাত আর পা যুক্ত থাকত। আকবরের দরবারে সম্মান জানানোর প্রথা ছিল আভূমি প্রণিপাত হওয়া বা সেলাম জানানো – এগুলি কুর্ণিশ, তসলিম এবং সিজদা তিন ভাগে বিভক্ত। আবুল ফজল লিখছেন, সম্রাট তার প্রজ্ঞান প্রয়োগ করে, জনগণের কাছ থেকে কি ভাবে সম্মান অর্জন করবেন, তার নানান তারিকা উদ্ভাবন করেছিলেন ... মহামহিম(আকবর)এর নির্দেশ ছিল, মাথা নামিয়ে(প্রায় আভূমি) ডান হাতের তোলাটা কপালে ঠেকানো... একে বলে কুর্নিশ, এবং এটা জ্ঞাপিত হয় যে সম্মান দেখানো ব্যক্তি তার মাথাটি(যেটা চেতনা আর মনের অধিষ্ঠান)তে হাতের নম্রতাকে স্পর্শ করে, দরবারে উপস্থিত করানো এবং সম্রাটের যে কোন কাজে নিজেকে সঁপে দেওয়ার আর্জি জানান।
তসলিম হল বাঁহাতের পৃষ্ঠভূমি মাটির সঙ্গে ঠেকিয়ে আস্তে আস্তে আনন্দের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে দেহটাকে খাড়া করতে থাকা যতক্ষণনা শরীরটা সোজা হচ্ছে।
সিজদা হল সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ। আকবরের দরবারে গোঁড়া ধর্মভীরু মুসলমানেরা যেভাবে প্রার্থনা করতেন। আকবরের নির্দেশ ছিল এটি তার সামনে ব্যক্তিগতভাবে করতে হবে জনসমক্ষে নয়। তবে অন্যান্য সম্রাটের সময়েও এটি চলে এসেছে।
আবুল ফজল বলছেন দরবারে যে মানুষটি সম্মান জানাচ্ছেন, তিনি আদতে নিজেকে সঁপে দেওয়ারই কাজ করছেন, তার মাথা মুঘলদের কাছে উপহার দিচ্ছেন। যুদ্ধে আত্মতোতসর্গ ছিল আক্ষরিক। সম্রাট আকবরের সময়ে আঁকা একটি মুঘল চিত্রশৈলীতে দেখতে পাই তার এক যোদ্ধা তার শত্রুপক্ষকে নিয়ে এসে সম্রাটের হাতির পায়ের কাছে জড়ো করে রাখছে। পরাজিত শত্রুদের কারোর মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই, পাগড়িও নেই, মাথাগুলি নামানো, তাদেরকে বিজিতর সামনে আনা হয়েছে।
অষ্টাদশ এবং নবম শতকে কোন ভারতীয় যদি তার শিরস্ত্রান কারোর পায়ের কাছে রাখত, সেটা তার পরাজয় বা আত্মসমর্পন বলেই গণ্য হত। এই আত্মসমর্পণের চিত্রটা রূপকশোভিতভাবে বাক্যেও ব্যবহৃত হয়েছে। ভারতে ভ্রমনে আসা ব্রিটিশদের জন্যে লিখত নির্দেশিকা পুস্তকে লেখা থাকত কোন হিন্দু আর মুসলমানের পাগড়িতে হাত না দিতে, কেননা সেটি অপমান হিসেবে গণ্য হত।
১৮৪০ সালে ব্রিটিশেরা সিন্ধ জয় করে। সেই অঞ্চলটি মুসলমান জমিদারেরা ছিল যাদের কাছে পাগড়িই স্বাধিকারের সমান ছিল। ফারসি আর সিন্ধ ভাষায় দক্ষ এক কোম্পানি কর্মচারী ই বি ইস্টউইক পাগড়ির উপযোগিতা বিষয়ে বিশদে লিখছেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড এলিনবরো জেনারেল নেপিয়ারকে কোন এক বিশেষ শাসককে সমর্থন এবং তার পাগড়ি বিষয়ে লিখছেন, আই হ্যাভ লিটল ডাউট ওয়ান্স এস্টাব্লিশড ইন দ্য পজেশন অপব টার্বান... আলি মুরাদ উইল বি এবল টু এস্টাবলিশ দ্য মোর ন্যাচুর্যাবল এন্ড রিজোনেবল লাইন অব সাক্সেশন টু দ্য টার্বান, এন্ড ক্লোদ দ্য মেজার উইথ দ্য ফার্মনেস অব লিগালিটি।
মধ্য ইওরোপে যেমন শিরস্ত্রানের একটা বড় ভূমিকা ছিল, তেমনি ভারতের মুঘল শাসকেরাও পাগড়ি আর তার সঙ্গে জুড়ে থাকা গয়নাগুলির সঙ্গে ঐশ্বরিক ক্ষমতা আর চরিত্র জুড়ে ছিল। পাগড়ির সঙ্গে জুড়ে থাকা গয়না যেমন কালঘি – সারস বা ময়ূরের পালকের সঙ্গে জুড়ে থাকা রত্নর গুরুত্ব বিপুল ছিল। এইটা সর্বোচ্চ অভিজাতদের দেওয়া হত। জিঘা ছিল সোনায় তৈরি চাঙ্গড়ের ওপর কয়েকটা রত্ন বসানো তার সঙ্গে যুক্ত থাকত ময়ূরের পালক। সরপেঁচ বা সরবন্দ হল পাগড়িতে সেলাই করা সোনা বা রূপোর সূক্ষ্ম তারের কাজের ওপরে রত্নের সমাহার বসানো। পাগড়ির ওপর রত্নের কাজ করা মুক্তো শভিত উষ্ণীষ জড়িয়ে দেওয়া হত। মধ্যযুগের হিন্দু ঐতিহ্যে রাজারা বিশ্ব আর তার উতপাদনের মালিক। মহাকাশীয় বিবরণসূত্রে বলতে পারি পৃথিবীর সারমর্ম হল রত্নরাজি, এবং এগুলি খাঁটি ঘণীভূত এবং পবিত্র বস্তু। ফলে কাপড়, পাগড়ি এবং সেগুলোর সঙ্গে জুড়ে থাকা রত্নরাজি আদতে বিশ্বের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
No comments:
Post a Comment