অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
ব্রিটেনে অথবা
ভারতে থাকা ব্রিটিশেরা যুদ্ধের লুঠ, দখল আর হত্যার মধ্যেই আর্জিত নানান ধরণের সব
বস্তুকে গুরুত্বপুর্ণ ভাবতে শিখল। উনবিংশ শতাব্দে ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় মদতে
লুঠের মাধ্যমেই প্রচুর মূল্যবান এবং জনপ্রিয় নানান কারিগরি এবং অন্যান্য জিনিসপত্র
লন্ডনে গিয়েছিল। ১৭৯৯(বইতে ভুল ছাপা হয়েছে ১৮৯৯ সাল) সালে টিপু সুলতানের হারের পর
শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতনের উল্লাসে টিপুর সঙ্গের জুড়ে থাকা বহু দ্রব্য লুঠ হয়ে
নিলামের বাজারে চলে এসেছিল। এই লুটে ছিল টিপুর বাঘ, তার মুকুট, দেহবর্ম, সিংহাসন
থেকে লুঠ হওয়া বাঘের মাথা, একটি রয়্যাল কার্পেট। এগুলি কোর্ট অব ডিরেক্টর্স এবং
রাজপরিবারের সদস্যদের উপঢৌকন দেওয়া হয়। এবং কয়েক বছরের মধ্যেই সেগুলি লিডেনহল
স্ট্রিটের মিউজিয়ামে প্রদর্শনীর জন্যে হাজির হয়।
১৮২০ থেকে ১৮৬০
সালের মধ্যে শ্রীরঙ্গপত্তনমের বিজয় দেখানো চিত্রকলার চাহিদা বিপুলভাবে বেড়ে গেল
ইস্ট ইন্ডিয়া হাউসে এবং তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট জাদুঘরটিতে। জেনারেল ডেভিড বার্ডের
টিপুর মৃতদেহ সনাক্তকরণ, টিপুর মৃত্যু এবং টিপুর দুই ছেলের আত্মসমর্পণ বর্ণনা করে
আঁকা ছবি বিপুল্ভাবে লন্ডনের অভিজাতদের বাড়িতে চাহিদাবন্ত হয়ে উঠল। টিপুর হার আর
চিরাচরিত শত্রু এবং শয়তান বাঘ টিপুর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ শক্তির জিত বর্ণনা করে
হাজারো নাটক, ব্যঙ্গ, গীতিকবিতা, ছড়া ইত্যাদি ছেয়ে গেল লন্ডনে।
১৮২০ থেকে ১৮৬০
সাল পর্যন্ত যে সব জনপ্রিয় লন্ডন ঘোরার নির্দেশনামা লেখা বইতে ইস্ট ইন্ডিয়া হাউস এবং
তার সংলগ্ন মিউজিয়াম সম্বন্ধে কিছুটা হলেও আলোচনা করেছে। সপ্তাহে মাত্র কয়েকদিন
খোলা থাকা মিউজিয়ামে ঢুকতে হত গাঁটের কড়ি খরচ করে। দারোয়ানকে কিছু উপরি দিলে আরও
বেশি কিছু দেখার ব্যবস্থা হয়ে যেত। যদিও ফারগুসন এই মিউজিয়ামে অমরাবতী স্থাপত্য
দেখেছিলেন বলে দাবি করছেন, কিন্তু সে সময়ের নথি বলছে এই মিউজিয়ামে এধরণের কোন স্থাপত্য
ছিল না, শুধু টিপুর হারের আর শ্রীরঙ্গপত্তনমের পতনে ব্রিটিশ বিজয়ের সঙ্গে জুড়ে
থাকা কিছু স্মৃতিচিহ্ন।
নিচের তালিকাটি
তৈরি করেছেন ব্রিটন এন্ড পুগিন ১৮৩৮ সালে। এই তালিকা থেকে আমরা বুঝতে পারি কোম্পানি
কি ধরণের বস্তু তার মিউজিয়ামের জন্যে সংগ্রহ করত
জাভার টাপির,
চারপায়ের জন্তু হগের মত, কিছুটা লম্বা ঝুলন্ত শুঁড়, অনেকটা দক্ষিণ আমেরিকার
ট্যাপিরের মত। জাভায় হর্সফিল্ডের গবেষণায় এই নতুন ধরণের জন্তু আবিষ্কৃত হয়েছে
জাভা থেকে সংগৃহীত
বিড়াল আর হনুমান প্রজাতির চতুস্পদ জন্তু
জাভা থেকে
সংগৃহীত পাখি, পালকের সৌন্দর্যে চোখ টানে, একই দ্বীপপুঞ্জ থেকে; এছাড়াও ভারত আর
সিয়াম আর কোচিন চিনের পাখি; আর উত্তমাশা অন্তরীপের পাখি।
ভারত থেকে আনা
সিংহের চামড়া, যেটা এশিয়ায় বেশি দেখতে পাওয়া যায় না বলে এর অস্তিত্ব স্বীকৃত
হচ্ছিল না এতদিন,
জাভার পোকা,
কিছুটা প্রজাপতির মত দেখতে
সিঙ্গাপুরের সমুদ্রজাত
কাপ অব নেপচুন, একখণ্ড প্রবাল
কাঠের ওপর কাঁসা পাথর
তৈরি চিনা নৈসর্গ দৃশ্য; হাতির দাঁতের আর রূপো এবং মাদার অব পার্ল দিয়ে তৈরি
মন্দির তার সঙ্গে মানুষ, পাখি, গাছ
চিনা অঙ্কন, যার
মধ্যে একটা চিনা উৎসব, সাধারণ চিনা ছবির তুলনায় গভীরভাবে আঁকা
টিপু সাবের সোনায়
তৈরি বাঘের মাথার আকারে চারপায়া সিংহাসন, চোখ আর দাঁতগুলি ক্রিস্টালের। অসাধারণ
সিংহাসন, যা টিপু মহীশূরের সিংহাসনে বসেই তৈরি করান। এটি নিরেট সোনার তৈরি, বসার
আসনটা মাটির থেকে তিন ফুট উঁচুতে। বিশাল বিশাল সৌন্দর্যের আর আকারের ক্রিস্টাল, মণিমুক্তো
খচিত সোনার স্তম্ভের মাথায় একটা চাঁদোয়ার মত করা। বিজিতরা এটি খণ্ড খন্ড করে কেটে উপহার
হিসেবে সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছিল
একটি গানগাওয়া
বাঘ, টিপুর প্রাসাদ থেকে পাওয়া। একটা এক ধরণের হ্যান্ড অর্গান, বাঘের আকারে তৈরি
করা। বাঘের তলায় একজন মানুষ শুয়ে রয়েছে, বাঘ গর্জন করছে আর মানুষটার আর্তনাদ শোনা
যাচ্ছে।
টিপু সাহেবের
অস্ত্রশস্ত্র। সেলাইকরা সুতি আর সবুজ রেশমে আবৃত মাথা আর গায়ের বর্মের সঙ্গে, যে বর্ম
যে কোন আঘাত সহ্য করতে সক্ষম
প্রাচীন
ব্যবিলনের ইউফ্রেটিস নদের ত্যীরের পাহাড় থেকে আনা ইঁট। তাতে নখে আঁকা লিপি খোদায়
করা হয়েছে। এই লিপিগুলি চিনাদের মত লম্বভাবে না ইওরোপিয়দের মত শুইয়ে পড়তে হবে তা
নিয়ে জ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক আছে।
No comments:
Post a Comment