অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
১৯৫৯ সালের
লন্ডন। জনৈক শিখ জি এস সাগর ম্যানচেস্টার ট্রান্সপোর্টে গাড়ির চালক হতে আবেদন
করেন। তার আবেদন খারিজ হয়ে যায় কেন তিনি না তার সমাজের কৌম চিহ্ন পাগড়ির বদলে স্থানীয়
প্রশাসনের দেওয়া প্রত্যেক বাহন কর্মচারীর নির্দিষ্ট পরিধেয়র অংশ টুপিটি পরতে
অস্বীকার করেন। সাগরের যুক্তি ছিল এটি তার আবশ্যিক ধর্মীয় পরিচয় বাহক। তিনি বুঝতে
পারছিলেন না, কেন হাজারো শিখ, পাগড়ি পরেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হয়ে কয়েকশ যুদ্ধে
অংশ নিয়ে সাম্রাজ্যকে বিজয়ী করেছে, তাহলে তিনি কি দোষ করলেন। যান ব্যবস্থাপকদের
বক্তব্য ছিল, চাকরির যায়গায় পরিধেয় পরতে যদি কোন ব্যতিক্রম ঘটে তাহলে সেই
ব্যতিক্রমের ঠেলা তাদের সংগঠনকে কোথায় নিয়ে ফেলবে তারা বুঝতে পারছেন না। ফলে কোন
ব্যতিক্রম ছাড়াই কর্মক্ষেত্রে যে পরিধেয় ঠিক হয়েছে, তাকে মান্য করতে হবে।
আমরা জানি কিভাবে
চাকরিদাতারা, তাদের ইচ্ছে অনিচ্ছে নৈতিকতা জোর করে কর্মপ্রার্থীদের পরিধেয়, চেহারা
এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস মেনে চলার ওপর চাপিয়ে দেয়। এই বিতর্কের সাত বছর আগে এই
ধরণের পরিধেয় পরা নিয়ে আন্দোলন চলছিল, বিশেষ করে স্কচদের কিল্ট নিয়ে যা তাদের
জাতীয় চরিত্র রূপে স্বীকৃত – জাতীয় পরিধেয়, সেটি আইনিভাবে কর্মচারীর পক্ষে পরার
ব্যবস্থা করা যায়। শিখেদের যুক্তি হল পাগড়ি পরিহিত কোন শিখের চাকরি না পাওয়ার অর্থই
হল ধর্মীয় বিভেদ সৃষ্টি করা। কর্মচারীদের সংগঠন এই বিবাদে কর্তাদের পক্ষেই দাঁড়ায়
এই যুক্তিতে যে কোন ব্যক্তিগত কর্মচারী কর্তৃপক্ষের তৈরি করে দেওয়া নিয়মের
বিরোধিতা করতে পারে না, যা আদতে কর্মচারী সঙ্গঠন-কর্তাদের মধ্যে দরকষাকষিকরে ঠিক
হয়েছিল।
এই বিতর্ক আরেক স্তরে
উঠে আসে যেখানে সাদাদের ঐতিহাসিকভাবে অসাদা চামড়ার মানুষ, অদ্ভুত ধর্মীয় আচার পালন
করা মানুষ, অদ্ভুতভাবে জামাকাপড় পরা মানুষ, যাদের তারা শস্তার শ্রমিক হিসেবে দেখে
তাদের দেশে বাস করার অধিকার দিয়েছে, তারা আদতে সস্তার কাজ করে সেদেশের সাদা সরল
দক্ষ সৎ শ্রমিকদের মজুরির স্তর কমিয়ে দিচ্ছে। বাস্তব হল, সাদা ব্রিটিশ শ্রমকেরা
পরিষ্কার, তুলনামূলকভাবে সহজ, অপরিশ্রমী এবং বেশি মাইনের কাজে উৎসাহী বলে শস্তার
শ্রমিকদের প্রতি এইসব জাতিবাদী মন্তব্য করেছে। এছাড়াও কিছু মধ্যবিত্ত ব্রিটিশ নতুন
কমনওয়েলথ থেকে আসা অভিবাসীদের তাদের ব্রিটিশ সমস্বত্ত্বতার কৃষ্টির ওপর আঘাত
হিসেবে দেখলেন। ভারত, পাকিস্তানি, বাংলাদেশিদের পরা পাগড়ি, কালো চামড়া, শাড়ি এই
আঘাতের চিহ্ন।
সংক্ষেপে বলতে
গেলে, শিখের পাগড়ি বিতর্ককে আমাদের দেখতে হবে আড়াইশ বছর ধরে ভারতীয় আর ব্রিটিশ
সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে চলতে থাকা আর্থিক রাজনৈতিক এবং কৃষ্টিগত উচ্ছেদের ইস্যু
হিসেবে। এই বিতর্ককে বুঝতে আমাদের উনইবিংশ শতকে ব্রিটিশ আর ভারতীয়দের পরিধান বিষয়ে
দৃষ্টি নিবদ্ধ এবং আলোচনা করতে হবে; আলোচনা করতে হবে কি করে সাদা শাসক আর কালো
শাসিতের মধ্যে বাহ্যিক দূরত্ব তৈরি হল; ব্রিটিশ উপনিবেশে শাসক আর শাসিতের
প্রতিনিধিত্বের পোষাক পরিচ্ছদের মধ্যে বিচ্যুতির যে সম্পর্ক তৈরি হল।
পরিচিতির চিহ্ন
হিসেবে পাগড়ি
সাগরের পাগড়ি পরে
কাজ করার অধিকার চাওয়ার মধ্যে ব্রিটেনে যে বিপুল বিতর্ক তৈরি হল সেটা আদতে বেশ
কয়েক শতাব্দ ধরে এশিয়া আফ্রিকায় উপনিবেশ হারানো এবং বহু উপনিবেশে স্বাধীনতা চাওয়া
প্রজাদের আর মুক্ত উপনিবেশের প্রজাদের প্রাক্তন শাসকদের সমান হয়ে দাঁড়ানোর দাবিতে
প্রায় অসহায় সম্বলহীন হয়ে পড়া ব্রিটিশ প্রতিক্রিয়া। ব্রিটেনজুড়ে পরিধেয় বিষয়ে গোটা
মধ্য এবং উচ্চশ্রেণীভুক্ত সামাজিক স্তরে বিপ্লব আসছিল। নিচের শ্রেণীর যুবারা, বড়
এবং প্রবীনদের পরিধেয়র আঙ্গিকে প্রভাব ফেলছিল, প্রাচীন কালে যে সব পরিধেয়
উচ্চমার্গের বলে চিহ্নিত হত সেগুলি নিয়ে ব্যঙ্গ, বাতিল করার মাধ্যমে এই নিম্নবিত্ত
যুবারা নিজেদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল।
এই দীর্ঘ
ব্রিটিশিয় প্রাক্তন শাসক আর প্রাক্তন শাসিতের মধ্যে পরিধেয় নিয়ে চলতে থাকা লড়াইতে
শিখদের পাগড়ি আরেকটি বিদ্রোহী আঙ্গিক হিসেবে যোগ হল। অথচ মজার তথ্য হল শাসক ব্রিটিশেরাই
উনবিংশ শতাব্দে শিখদের পাগড়িকে শিখ সমাজের পরিচয় চিহ্ন হিসেবে তৈরি করেছিলেন।
No comments:
Post a Comment