অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
উনবিংশ শতাব্দীর
ইংলন্ডে বিভিন্ন ধরণের গুরুত্বপূর্ণ চিত্রকলা সংগ্রাহক ছিল, তাদের মধ্যে একজন
বিপুল পরিমানে ভারতীয় স্থাপত্য সংগ্রহ করেন। ১৭৭৪ সালে কোম্পানির কর্মকর্তা,
উইলিয়াম ওয়াটসনের হাতে রোহিলা যুদ্ধের সময় প্রচুর পরিমান ভারতীয় স্থাপত্য এসে যায়।
আজকে এটি মনলি রাগমালা নামে সারা বিশ্বে পরিচিত। রবার্ট ক্রান এর তারিখ নির্ণয়
করেছেন সপ্তদশ শতাব্দ ধরে। ১৮১৫ সালে ওয়াটসন তার কন্যাকে ছবিগুলি দিয়ে লিখে যান,
গিভস য়ু আ পারফেক্ট আইডিয়া অব দ্য কাস্টমস, ম্যানার্স এন্ড দ্য ড্রেস অব দ্য মেন
এন্ড ওমেন ইন বেঙ্গল, পারসিয়া এন্ড মোস্ট পার্টস অব দ্য ইস্ট ইন্ডিজ... অলসো অব
দেয়ার বার্ডস, ট্রিজ এন্ড প্ল্যান্টস। তিনি প্রত্যেকতা ছবির টিকাও করে দিয়ে যান।
কয়েকটি ধারাবাহিক
প্রকাশনায় মিল্ডার্ড আর্চার অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয় পাদ থেকে শুরু করে উনবিংশ
শতাব্দের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষণার যে ইতিহাস লিখছেন, তাতে
দেখি, এই চিত্রকলাগুলিতে বিশদে ভারতীয়দের সামাজিক প্রথা, জামাকাপড়, পেশার ইঙ্গিত
পাওয়া যায়। ব্রিটিশ যে কটা শিল্প ভারতীয় শিল্পীদের বরাত দিয়ে অথব খোলা বাজার থেকে
খুব বেশি করে সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে চিত্রকলা অন্যতম। গৃহস্থ বাড়ির একমাত্র
ভৃত্যরাই ইওরোপিয়দের হাতে নাগালে ছিল। যারা প্রথম ভারতে আসতেন তাদের একদল চাকরবাকর
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কাজ করতেন।
ভারতে ভ্রমন করার
প্রথম নির্দেশিকা লেখক দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া ভাদে মেকুম(লন্ডন ১৮১০) ক্যাপ্টেন টমাস
উইলিয়ামসন লিখলেন ভারতে বিপুল সংখ্যায় চাকরবাকর দেখা যায় কারন তারা বিভিন্ন
গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে থাকে যাকে আমরা কাস্ট বলি। উইলিয়ামসন বাড়ি আর দপ্তরে কাজের জন্য
৩১ রকমের ভৃত্যের প্রকার লিখেছিলেন। উইলিয়ামসনের এই ভাগকে আমরা উচ্চ ও নীচ এই দুই
ভাগে ভাগ করতে পারি। উচ্চতমপদে কাজ করা ভৃত্যদের নকরোঁ বলা হত। এদের মালিকেরা ভরসা
আর বিশ্বাস করতেন। এরা সাধারণত পরিশ্রমের কাজ করতেন না, মূলত নজরদারি আর খবরদারির
কাজ করতেন। নিচুস্তরের ভৃত্যরা যাদের চৌকিরঁ বলা হত তাদের নিজস্ব স্তরীভবন ছিল।
এদের যে অংশ বাড়ির ভেতরের কাজ করতেন তারা সাধারণ বাড়ির কাজ, টেবলে অপেক্ষা করা,
রান্না করা, মদ্য ঠাণ্ডা করার কাজ, হুঁকা বরদার, আসবাব ঠিক রাখা ইত্যাদির কাজ
করতেন। যারা বাড়ির বাইরের কাজ করতেন, তদের মধ্যে মালি, পালকিবাহক, সহিস, ধোবি,
পিয়ন, দারোয়ান আর নজরদার(ওয়াচমেন)।
এই বাড়ির কাজ
করার ভৃত্যাবলীর পদের অবস্থানের মডেলের সূত্রে দিয়ে ব্রিটিশেরা ভারতীয় সমাজকে
বিশ্লেষণ করেছিল। ধরে নেওয়া হল জাতিব্যবস্থায় নির্দিষ্ট জাতির নির্দিষ্ট কাজ ধার্য
করা আছে, এবং সেই কাজ অন্য সমাজ করবে না। জাতিব্যবস্থার উচ্চাবচ নির্ধারিত হল
কাজের সূত্র ধরে যেখানে বলা হল বিশ্বস্ত ভৃত্যদের ভারতীয় সমাজের উচ্চবর্ন থেকে
নেওয়া হত। মুসলমানেদের লেখক আর শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করা হত। টেবলে যারা অপেক্ষা
করতেন তারা সাধারণত মুসলমান ছিলেন, যাদের সাধারণত খাদ্য, বিশেষ করে বিদেশি খাওয়ার
ছোঁয়াছুঁয়ির অতটা বাছবিচার ছিল না। রাঁধুনিরা নিচু জাতের, অস্পৃশ্য বা পর্তুগিজ,
কারণ মনে করা হত উচ্চবর্ণ হিন্দুরা গরুর মাংস ছোঁয় না। খানসামা বা প্রধান পরিচালক
উচ্চবর্ণ বা উচ্চবর্ণ মুসলমান হতেন, কিছু ধনীগৃহে এই পদ অলঙ্কৃত করতেন পর্তুগিজ বা
এংলোইন্ডিয়ান। আয়ারা সাধারণত নিচু শ্রেণীর হতেন। টেলরেরা মুসলমান। মালি, ধোবা এবং
জলবাহক এই কাজের সংগে যুক্ত সমাজ থেকে আসতেন। অচ্ছুত চামারেরা সাধারণত আস্তাবলে
কাজ করতেন তারাই কুকুর এবং অন্যান্য গৃহপালিত পশুরও দায়িত্বে থাকতেন। প্রত্যেক
কাজের জন্যে নির্দিষ্ট কিছু সমাজের মানুষ আলাদা করে বাড়ির পাশে কুঁড়ে ঘর বানিয়ে
পরিবার নিয়ে থাকতেন।
উনবিংশ শতাব্দ
জুড়ে গৃহভৃত্য এবং তাদের কাজকর্ম ইত্যাদি উপস্থাপন করা ঔপনিবেশিক চিত্রকলার অন্যতম
বিষয় ছিল, যে ছবিগুলি ব্রিটিশ আর ভারতীয় আঁকিয়েদের দিয়ে আঁকানো হয়েছিল। যে সব আমলা
বা ব্রিটিশ দেশে ফিরে যেতেন, তারা ভারতের স্মৃতি হিসেবে এই চিত্রকলাগুলি এবং এর
সঙ্গে ভারতীয় দামি বস্ত্রও নিয়ে যেতেন। ভৃত্যদের কাজকর্ম, তাদের জাত, বিচিত্র
পরিধেয় ইত্যাদি ভারতে এবং বিদেশিদের কাছে আকর্ষণীয় ছিল।
No comments:
Post a Comment