অধ্যায় ৩
আইন এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র
অরাজক ভারতঃ স্বৈরাচার(ডেসপটিক) তত্ত্ব
সংক্ষেপে বলতে গেলে ব্রিটিশেরা বিশ্বাস করত মুঘল-ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ভর করত একজন সর্বময়ের স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার, বাক্যের আর ইচ্ছার ওপর, কোন সামাজিক-রাজনৈতিক সাঙ্গঠনিক নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই সে সম্পত্তি আর সম্মান দান করতে পারত। উত্তরাধিকারের কোন নির্দিষ্ট আইন ছিল না, জৈষ্ঠপুত্রের স্বাভাবিকভাবে সিংহাসন লাভের কোন প্রথা ছিল না বরং রাজ সদস্যদের লড়াই করে সিংহাসনের অধিকার দখল করতে হত। বিচার আইন মোতাবেক হত না বরং ব্যক্তি নির্ভর ছিল, এবং বিচারক অর্থ, সম্মান এবং যোগাযোগের প্রভাবে সহজেই প্রভাবিত হতে পারত।
ভারত যে স্বেচ্ছাচারী সম্রাটের দ্বারা শাসিত হত এই তত্ত্বটি নতুন করে কল্কে পেল উনবিংশ এবং বিংশ শতকে যখন বহুবিধ শাসন দৃষ্টান্ত বিষয়ে তাত্ত্বিক পরিকাঠামো গড়তে ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থার বৈধতা আলোচনা চলছিল। এই তাত্ত্বিক পরিবেশের মোটামুটি চলনসই সংস্করণটি হল, শক্ত হাতে ভারতকে শাসন করা প্রয়োজন, যে স্থায়ী নীতি আর আইনের সাহায্যে হাতেগরম বলশালী(রাফ) শাসন এবং বিচার দিতে সক্ষম। আদালত, তার চালন পদ্ধতি, আইন, প্রথা, ভারতীয়দের প্রায়শই মিথ্যা শপথ নেওয়া এবং মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া সাক্ষীদের উতকোচ দেওয়ার জন্যেই সাধারণের বিচার পেতে, দিতে দেরি হয় এবং এই জন্যই গ্রামের চাষাভুষোরা শহুরে উকিল, ব্যবসায়ী এবং আন্দোলনকারীদের হাতে নিগৃহীত হয়। জনগণ চায় বলশালী স্বেচ্ছাচারী কিন্তু কল্যাণমূলক শাসন, কিন্তু শহুরেদের দুর্ণীতিতে সেই সুযোগটা গরীবমানুষেরা পায় না। কল্যাণমূলক স্বেচ্ছাচারী হিসেবে ব্রিটিশেরা নানান আঙ্গিকে বহু সময়ে ভারতের জনগণের সামনে উপস্থিত হয়েছে কখোনো আদর্শবাদী অভিভাবক হিসেবে যেখানে সাধারণ মানুষ স্বচ্ছাচারীদের মা-বাপ হিসেবে ডেকে থাকে, প্রভুত্বব্যাঞ্জক যুক্তিবাদী হিতবাদী হিসেবে এবং টালমাটাল/সঙ্কটের সময়ে কল্যাণমূলক শাসনের ছিটেফোঁটা না থাকা ওল্ড টেস্টামেন্ট এভেঞ্জারদের মত।
ধর্মতাত্ত্বিক(আইনের আরেক নাম ধর্ম - অনুবাদক) শাসনে ভারতঃ ভারত রাষ্ট্রের ধ্রুপদী মডেল
ব্রিটিশ জ্ঞানীদের প্ররোচনায় সন্তর্পনে ভারত রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারী মডেল তৈরির সঙ্গে সঙ্গে কলকাতায় বসে হেস্টিংস আর কিছু সঙ্গীসাথী সেই তাত্ত্বিক অবস্থানের বিপ্রতীপ ধর্মতাত্ত্বিক মডেল বানাবার উদ্যোগ নিলেন। তার পরিককল্পনায় এই মডেলে থাকছিল হিন্দুদের অতীত থেকে আইনের বিশদ ধারাগুলির নথিকরণ এবং নবির সময় থেকে মুসলিম আইনের নথিকরণ। সে সময় হিন্দু আর মুসলিম সমাজে আইনের বিশদ পাঠ পাওয়া যেত সেই পাঠগুলি ধারক, বাহক এবং ব্যাখ্যাকারদেরও বিপুল পরিমানে অস্তিত্ব ছিল।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরের ১৭৭২ এবং ১৭৭৩ সালে পার্লামেন্টারি কমিটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় শাসন পদ্ধতি তদন্ত করে দেখছিল এবং বোঝার চেষ্টা করছিল ভারতের শাসন ব্যবস্থা তৈরি এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষা আর সমৃদ্ধি আনতে কোন কোন সংস্থা এবং শাসন ব্যবস্থা তৈরি করা জরুরি। তাত্ত্বিক অবস্থান হল, এই সময়ের কয়েক দশক আগে আগেই ভারত যেহেতু স্বেচ্ছাচারী মুঘল সাম্রাজ্য দ্বারা চালিত হয়েছে, তাই বর্তমান ব্রিটিশ শাসনে ভারতে অরাজক অবস্থা বর্তমান এবং এই মুহূর্তে আইনি শূন্যস্থান পূরণ করতে ভারতে ব্রিটিশ আইন এবং সংগঠন ভারতে জারি করা জরুরি। এই সমীক্ষাটি হাতে পেয়ে কোর্ট অব ডিরেক্টর্স আর পার্লামেন্টের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় করে হেস্টিংস বললেন ব্রিটিশ আইন খুবই পারিভাষিক, জটিল, এবং ভারতের জন্যে এক্কেবারেই উপযুক্ত নয়। তিনি বললেন বাংলার প্রাচীন সংবিধান আজও টিকে আছে। ১৭৭৪ সালে লর্ড চিফ জাস্টিসকে চিঠি লিখে ভারত যে স্বেচ্ছাচারী এবং যথেচ্ছ আর অস্থায়ী শাসক, অনির্দেশক বিচার দ্বারা পরিচালিত হত এবং বর্তমানের বা প্রাচীন হিন্দুদের কোন লিখিত আইন ছিল না এমন তত্ত্বের বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন অজানা অতীত থেকেই হিন্দুরা নির্দিষ্ট লিখিত আইন দ্বারা পরিচালিত এবং এর লিখিত রূপ অপরিবর্তিই রয়েছে। আইনগুলি ব্রাহ্মণেরা(সারা ভারতের প্রফেসরস অব ল) অবগত আছেন, যারা জনদান এবং পৃষ্ঠপষণা দ্বারা টিকে আছেন। এই পণ্ডিতেরা প্রায় দেবতার মত পুজো পান। ব্রাহ্মণ পেশাদারদের সামাজিক সম্মান এতটাই গভীরে পৌঁছেছিল যে মুসলমান শাসকেরাও তাদের ওপর অত্যাচার করতে সাহস পায় নি।
No comments:
Post a Comment