অধ্যায়২
সিদ্ধান্তঃ ভারতীয় জ্ঞানের পুনর্বিন্যাস
তুলনামূলক পদ্ধতিতে অন্তর্নিহিত ভাষার তত্ত্ব বলল, ভাষাগুলির মধ্যে জিনগত
সম্পর্ক আছে এবং তারা বিভিন্ন পরিবারের অংশ। একটা চিরকালীন সত্য ইওরোপ মেনে নিতে
বলল, যে এক সময় মাত্র একটিই ভাষা ছিল, তারপরে যেমন করে পরিবার বড় হয়, বিভক্ত হয়,
ভাষাও সেইভাবে বিভক্ত হয়ে চলে। ভাষা পরিবারে কোন একটি ভাষার স্থান হয়, তুলনামূলকভাবে
আভিধানিক, চিহ্নগত, মরফোলজি, এবং উচ্চারণগত চরিত্র নির্ধারণের পরে। এই পদ্ধতির
একমাত্র উদ্দেশ্য ইতিহাসের নির্মান; তুলনামূলক চরিত্র নির্ধারণ পদ্ধতিতে
পরিবারভূক্ত যে সব ভাষার মধ্যে যোগসূত্র বেরোল, সেগুলি হল সব থেকে ‘খাঁটি’ ভাষা। এই
কাজের উদ্দেশ্য হল অতীতের অনথিভূক্ত ভাষাগুলির পূনর্গঠন।
টিনেভেলির চার্চ অব ইংলন্ডের ধর্মযাজক রেভারেন্ড রবার্ট কডওয়েল এই পদ্ধতিটি
প্রয়োগ করে দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাগুলি যে আদতে ইন্দো ইওরোপিয় ভাষা পরিবারের অংশ, সেই
যুক্তিটা ‘সফল’ভাবে নির্মান করে দেখান। এই পরিবারকে বলা হল দ্রাবিড় ভাষা পরিবার।
কডওয়েলের দুটি লক্ষ্য ছিল, প্রথমটি ইওরোপিয় ভাষা তত্ত্ব দেশিয় ভাষার ক্ষেত্রে
প্রয়োগ করা, বিশেষ করে ভারতীয় ভাষা পরিবারগুলির ভাষার তুলনায় দ্রাবিড়িয় ভাষাগুলির
গুরুত্ব স্থাপন। এবং দ্বিতীয়টা হল দক্ষিণ ভারতের দেশিয় সাহিত্যকে তুলে ধরা, যাতে
বুদ্ধিমান শিক্ষিতদের চোখ পড়ে এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের জগতে প্রবেশ করতে পারে। অন্যান্য
ব্রিটিশদের মত তিনিও বিশ্বাস করতেন ভারতীয়রা বহুকাল ধরে ব্যকরণ চর্চা করছে, কিন্তু
সে পদ্ধতিটি পশ্চাদগামী এবং অবৈজ্ঞানিক। ইওরোপিয়দের উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় ভাষার রহস্য
ভেদ করে প্রগতিশীল চরিত্র অনুপ্রবেশ ঘটানো যাতে সেটি সুন্দর যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে
ওঠে। তুলনামূলক পদ্ধতিতে দ্রাবিড়িয় ভাষা আর দেশিয় সাহিত্য তুলনাকরে তারা বুঝলেন,
ভাষার নিজের ইতিহাস আছে, যা অন্যান্য ইতিহাসের ওপরে আলো ফেলতে সাহায্য করে, যা
দিয়ে জাতিতত্ত্ব এবং প্রত্নতত্ত্বের ইতিহাস খোঁজা সম্ভব।
তুলনামূলক পদ্ধতির ক্ষমতা/শক্তির মাধ্যমে একজন ভাষা পেশাদার, ভাষার বৈচিত্র
এবং এবং বিভিন্নতাকে চরিত্রবদ্ধ, নিবদ্ধ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ফেনোমেনোলজিরস্তরে,
ব্রিটিশ আবিষ্কার করল হাজারো ভাষা এবং উপভাষা যেগুলিকে নির্দিষ্ট তালিকাভুক্ত করা
যায় যা দিয়ে ভাষাগুলির পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করা যেতে পারে। যেমনভাবে
কুলুজি তালিকা করা যায়, ঠিক তেমনভাবে প্রত্যেকটি ভাষার অধস্তন প্রজন্মকে চিহ্নিত
করা সম্ভব, ঠিক যেমনভাবে গাছের শেকড় থেকে কাণ্ড বেরিয়ে ডালপালায় ছড়িয়ে যায় এমনকি
তার পল্লবও থাকে, ঠিক তেমনি ভাষাকেও একটি গাছের মত করে উপস্থাপন করা যায়। এখানে গাছটি
কিন্তু উত্তর ইওরোপের ওকে বা ম্যাপল হিসেবেই বর্ণিত হয়েছে, তারা কখোনোই বটগাছকে
ভাষা গাছের রূপক হিসেবে ব্যবহার করে নি।
তুলনামূলক পদ্ধতিটি সরলরেখা ধরে এগিয়েছে, বস্তু, ভাষা, সংগঠন প্রত্যেক স্তরে
প্রগতির পথে গিয়েছে এবং এটাকেই লক্ষ্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছে। এই পদ্ধতিকে পুরোনো
দিনের প্রাগৈতিহাসিক, শুদ্ধ, মূল ভাষা যেগুলি হারিয়ে যাচ্ছে বা গিয়েছে, সেই সব
সোনালী অতীতের ভাষা সম্বন্ধেও প্রয়োগ করা যায়। ভারতীয় ভাষা আর পাঠগুলির ক্ষেত্রে ইওরোপিয়
এবং ভারতীয় লেখকেরা প্রগতিশীল মডেল নয়, দ্বিতীয় হারিয়ে যাওয়া তত্ত্বটা নিলেন,
বললেন এগুলি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই সময়ের অবস্থায় বিজয়ী ইরোপিয়রা বলল ভারতীয় ভাষা
আর পাঠগুলি ক্রমশঃ নিম্নাভিমুখী হয়ে পড়ছে। এই ঢালে গড়য়ে পড়ার অবস্থাকে ঘুরিয়ে
দেওয়া যায় যদি হিন্দুদের অতীতের শুদ্ধ এবং প্রকৃত পবিত্র পুথিগুলিকে নতুন করে
জাগিয়ে তোলা যায়।
No comments:
Post a Comment