অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
পরিচিতির চিহ্ন হিসেবে পাগড়ি
শিখবাদ হিন্দু ও মুসলমানেদের মধ্যে পঞ্চদশ শতকে উত্তর ভারতে দুই সম্প্রদায়ের মিলনের একটা যৌথ আন্দলনের ফসল। এই পন্থের গুরু, গুরু নানক(আদতে জ্ঞানক>নানক – অনুবাদকার। সূত্র সুহৃদ ভৌমিক মশাই)এর বাণীগুলি লিখিত আকারে সঙ্ঘবদ্ধ হয় গুরু গ্রন্থ সাহিব নামে। এবং এই পন্থে উত্তরাধিকার সূত্রে গুরুদের পন্থ প্রচারকারী এবং আচার বহনকারী এবং ব্যাখ্যাকারী শিষ্য নির্বাচিত হতে থাকেন। ষোড়শ এবং সপ্তদশ শতক থেকে পাঞ্জাবে শিখদের ওপরে মুঘল শাসকেরা সামরিক বিপুল আক্রমন নামিয়ে আনে, কেননা পাঞ্জাব ছিল সামরিকভাবে মুঘলদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ন এলাকা – ভারতে বৈদেশিক আক্রমনের রাস্তার ওপরেই ছিল পাঞ্জাবের স্থান। ফলে শিখদের মধ্যে যুদ্ধ প্রবণতা এবং বিদ্রোহের জ্বালা তৈরি হতে থাকে।
দশম গুরু গোবিন্দ সিংহ শিখদের যুদ্ধ প্রবণতা এবং বিদ্রোহের জ্বালাকে নির্দিষ্ট আকার দান করলেন সেই সব মানুষদের নিয়ে যারা নিজেদের একসঙ্গে শুদ্ধ একজাতি বা খালসায় থাকাকে জায়েজ মনে করত। এর বাইরে থেকে গেল বিপুল জনসংখ্যা যারা নানান ধরণের পন্থে বিশ্বাস করত। ১৬৯৯ সালে এক নাটকীয় ঘটনায় গুরু গোবিন্দ সিংহ পাঁচজনকে তার পন্থের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনাকারী অনুসারী শিষ্য হিসেবে তৈরি করে নিলেন। এই পাঁচজনই গুরুর নির্দেশে, গুরুর হাতে নিজেদের মাথা কেটে ফেলার মত কঠোর সিদ্ধান্তে অচল রইলেন।
১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিংহ নববর্ষে বৈশাখীর দিন বিপুল শিষ্য সমাবেশ ঘটালেন। প্রত্যেক শিষ্য সেই জমায়েতে হাজির হল তাদের মাথার লম্বা চুল আর বিশাল আকাটা দাড়ি নিয়ে। মেলা উৎসব চললেও গুরু প্রকাশ্যে দেখা দিচ্ছিলেন না। হঠাত তিনি শিষ্যদের ডাক দিলেন গুরুর হাতে গুরুর প্রতি আত্মনিবেদনে মাথা বলিদান দেওয়ার জন্যে। একজন স্বেচ্ছাসেবক আর তার অনুগামীরা খোলা কৃপান হাতে গুরুর সঙ্গে গুরুর শিবিরে প্রবেশ করল। কোন কিছু শক্ত বস্তুর ওপরে তরোয়াল চালানোর শব্দ শোনা গেল, গুরু রক্তমাখা কৃপান হাতে তার শিবির থেকে বেরিয়ে এলেন। এই ভাবে পরপর আরও চারজনকে নিয়ে তিনি শিবিরে ঢুকলেন আর রক্তমাখা কৃপান হাতে বেরোলেন। পরে বোঝা গেল গুরু তার শিষ্যদের হত্যা করেন নি, তিনি পাঁচটা ছাগল হত্যা করেছেন নিভৃতে।
এই পাঁচজন নির্বাচিত হলেন খালসার মূল ধারণার ধারক বাহক হিসেবে। তাদের প্রত্যেককে নির্দিষ্ট আচারের মধ্যে দিয়ে যেতে হল, প্রত্যেকে একটি পাত্রে একসঙ্গে পানকরলেন নিজেদের মধ্যে সাম্যাবস্থা প্রদর্শিত করতে। এরপর তারা কিছু নিয়ম তৈরি করলেন, শিখেরা মাথা চুল আর দাড়ি কাটবে না, মদ আর তামাক পরিহার করবে, হালাল মাংস খাবে না, মুসলমান মহিলাদের সঙ্গে সঙ্গম করবে না। প্রত্যেকের উপাধি হবে সিংহ। আকাটা চুল(কেশ) রাখবে, তারা চুলে চিরুনি রাখবে(কাঙ্গা), হাঁটু পর্যন্ত জামা পরবে(কাচ্ছা), ডান হাতে ইস্পাতের বালা পরবে(কাড়া) এবং তরোয়াল(কৃপাণ) বহন করবে।
জে পি ওবেরয় এই পাঁচটি আচার পালনের নির্দেশ খুব বিশদে বিশ্লেষণ করেছেন, তার সঙ্গে অব্যক্ত আরেকটা নির্দেশ সুন্নত না করাকেও বিশ্লেষণ করেছেন। এর মাধ্যমে শিখেরা হিন্দু আর মুসলমান সম্প্রদায় থেকে আলাদা হয়ে গেল। তিনি দুটি তিনটি তিনটি করে পরস্পর বিরোধী আচার বর্ণনা করলেন প্রথম তিনটি, আকাটা চুল, তরোয়াল এবং সুন্নত না করা লিঙ্গ অনৈতিক(এমরাল) শক্তি, বিপজ্জনকও বটে। আর অন্য তিনটে চিরুণি, বালা আর বিশেষ পরিধেয় নৈতিক এবং আত্মনিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। এই দুয়ের মিলনে তিনি শক্তির স্ফূরণ তার তাকে নিয়ন্ত্রণের চরিত্র দেখলেন শিখদের মধ্যে।
No comments:
Post a Comment