অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
ব্রিটিশেরা
যেভাবে নিজেদের দেখাতে চাইল
ভারতীয়দের সঙ্গে
আলাপ আলোচনায় এবং বহিরাবরণে ব্রিটিশত্ব নিয়ে চলার প্রথা ভারতে শুরু হয়েছিল ১৬১৫
সালে রাজা প্রথম জেমসের প্রতিনিধি হিসেবে মুঘল দরবারে পণ্য ক্রয় এবং লাভের
উদ্দেশ্যে পাঠানো প্রতিনিধিদের পোষাকে। ব্রিটিশ দূত টমাস রোকে রাজার পক্ষ থেকে পই
পই করে বলে দেওয়া হয়েছিল টুবি কেয়ারফুল অব দ্য প্রিজারভেশন অব আওয়ার অনার এন্ড
ডিগনিটি, বোথ এজ উই আর সভরেন প্রিন্স এন্ড আ প্রফেসড ক্রিশ্চিয়ান, এজ ওয়েল ইন য়োর
স্পিচেস এন্ড রিপ্রেজেন্টেশন অব আওয়ার লেটার্স এজ ইন অল আদার সারকামস্ট্যান্সেস এজ
ফার এজ ইট স্ট্যান্ডেথ উইথ দ্য কাস্টমস অব দিজ কাট্রিজ। ভারতীয় দরবারে প্রতিনিধি
হিসেবে আসা রো, শক্তিশালী শাসকের দূত হিসেবে যে ধরণের ব্যবহার করার দরকার ছিল তা
করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। জাহাঙ্গির ব্রিটিশদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলেছিলেন এরা
নিকৃষ্ট ধরণের যোদ্ধা আর শাসক। রো’কে তার পছন্দ হয়েছিল ঠিকই এবং ব্যক্তিগতভাবে তার
উদ্ভট নানান বিষয় তিনি মেনেও নিয়েছিলেন, কিন্তু জাহাঙ্গির অবাক হয়ে গিয়েছিলেন, কি
করে এক শক্তিশালী ইওরপিয় শাসক শুধু ব্যবসার জন্যে রাজদরবারে প্রতিনিধিত্ব পাঠান। লাভ
বাড়াবার আর উপযোগিতার জন্যে রাজা জেমসের বার্তা নিয়ে যেভাবে রো তার সঙ্গে দরকষাকষি
করছিলেন সেটা জাহাঙ্গির মোটেই পছন্দ করেন নি।
ব্রিটিশদের ব্যবসা-চুক্তি
করার উদ্যম আদতে ব্যবসা হিসেবে ইওরোপিয় ধারনার ফলশ্রুতি, যারা কিছু কৃষ্টিকে পণ্য
হিসেবে ব্যবহার করত। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে তারা ভারত থেকে ইংলন্ডে পাঠানোর বা দক্ষিণ
পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এই কাপড়ের বিনিময়ে লন্ডনের জন্যে মশলা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে
যে সব পণ্য কিনতে শুরু করে সেগুলির মধ্যে ছিল বিচিত্র ধরণের বস্ত্র। সমস্যা হল
ব্রিটিশেরা যে সব পণ্য উতপাদন করত যেমন পশম, ধাতু দ্রব্য, এবং নানান ধরণের অদ্ভুত
কিসিমের পণ্যের খুব বড় বাজার ভারতে ছিল না। ভারতীয়দের চাহিদা ছিল রূপো, তামা এবং
সোনা। আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল ব্রিটিশ ভারতীয় বস্ত্রকে শুধুই কোম্পানির আর
কোম্পানির অংশিদারদের লাভ করার জন্যে উপযোগী এবং ব্যবসায়িক পণ্য হিসেবে দেখতে শুরু
করায়। ভারতীয়রা যে সব বস্ত্র উতপাদন করত সেগুলির পণ্যমান এবং উপযোগিতা অবশ্যই ছিল,
কিন্তু উতপাদনে আর ব্যবহারে আরও নানান বিষয় জড়িয়েছিল, ব্রিটিস যেগুলিকে পণ্য
হিসেবে দাগিয়ে দিচ্ছিল ক্রমাগতভাবে।
রো আর তার ছোট
দলটিতে তার চ্যাপলেইন হিসেবে ছিলেন রেভারেন্ড টেরি, মুঘল দরবারে গিয়ে বুঝলেন মুঘল
দরবারে যে সব কাপড় আসে, ব্যবহার হয়, উপহার দেওয়া হয়, সেগুলির মূল্য বাস্তবিক জীবনের
সঙ্গে যুক্ত পণ্যের পণ্যায়নের থেকে অনেক বেশি। জাহাঙ্গির রো’কে ইওরোপিয় প্রথায় টুপি
খুলে আর ঝুঁকে অভিবাদন করতে দেন নি বরং সম্রাটকে শ্রদ্ধা দেখানোর মুঘল রাজসভার
রীতিনীতি রো’কে মানতে বাধ্য করেছিলেন। তিন বছর রো আর তার সাথীরা হাল্কা ঠাণ্ডা
ইওরোপিয় পোষাকেই জাহাঙ্গীরের সঙ্গে ভারত ঘুরেছিলেন, তার ভৃত্যরা সকলেই লাল তাফেতা আলখাল্লার
মত পরিধেয় পরত। টেরি চ্যাপলেইন সবসময়ে দীর্ঘ কালো ক্যাসক পরতেন।
মুঘল দরবারের
জন্যে রো প্রচুর উপঢৌকন নিয়ে এসেছিলেন তার মধ্যে ছিল লাল টকককে কস্তা রঙের কাপড়,
যা হয়ত উত্তর আমেরিকার আদবাদীদের বেশি মানাত মুঘলদের উপহার দেওয়ার থেকে। রো আর সেই
কাপড় জাহাঙ্গিরকে দেন নি বরং তার নিজের উত্তরীয় আর তরবারি উপহার দিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গির তার দেওয়া উপহারের প্রশংসা করে রো’কে বলেছিলেন তার ভৃত্যকে পাঠিয়ে এগুলি
ঠিকঠাক করে বেঁধে আনতে। রো বলেছেন বহু সময় জাহাঙ্গির এবং তার কিছু অভিজাত তাকে
পরিধেয়, গয়নাপত্র এবং পাগড়ি দিতে চেয়েছ্যিলেন। রো বলেন নি কেন তিনি এই উপহারগুলি
নেন নি, আমি আন্দাজ করতে পারি, তিনি এই উপহার দেওয়ার গুরুত্বটা যথেষ্টভাবেই
বুঝেছিলেন। এই উপহার গ্রহণ করলে হয়ত তার মুঘলদের অধীন হয়ে পড়ার আশংকা ছিল। কেন
জাহাঙ্গির রো’র দেওয়া তরোয়াল আর উত্তরীয়তে খুশি ছিলেন আর কেন রো জাহাঙ্গিরের থেকে উপঢৌকন
নিতে সতর্ক থাকতেন, সেটা বিশ্লেষণ করা যাবে মুঘল ভারতের কর্তৃত্বের সংবিধানে।
No comments:
Post a Comment