অধ্যায়২
শিক্ষা এবং অতীত সংরক্ষণ
স্মৃতিতে ধারণ করে রাখা শিক্ষার একটা যে অংশ এটা ব্রিটিশেরাও গ্রহণ করেছিল। ব্রাউনের
অভিযোগ পণ্ডিতেরা তাকে মনে রাখার জন্যে চাপ দিত কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও তারা
জানত যে ব্রাউন বাইবেল, সেক্সপিয়ার আর মিলটন হৃদয়ে রাখত, সেই জন্য তাকে তারা
শ্রদ্ধা করত। ব্রিটিশদের হতবুদ্ধি করে দিত ভারতীয়দের অমানুষিক মুখস্থ আর মনে রাখার
ক্ষমতা। একই সঙ্গে তাদের সন্দেহ হচ্ছিল যে যেটা ভারতীয়রা মুখস্থ করে শিখছে সেটা
আদতে তারা বুঝছে কিনা।
১৮২৩ সালে বেলারি জেলায় এ ডি ক্যাম্পবেল দেখলেন বিদ্যালয়ে ছাত্রদের কাব্যিক
ভাষার বাক্যের দলগুলির সঠিক উচ্চারণের ওপর জোর দিচ্ছে, কিন্তু শব্দের মানে বোঝানোর
চেষ্টা হচ্ছে না। তিনি আবিষ্কার করলেন যে শিক্ষক যত পুথি মুখস্থ করেছেন, তার
সারমর্ম তারা বলতে পারেন না। এর পরিণাম হল, ছাত্ররা পাখিপড়ার মত করে যা মুখস্থ
করছে, সেগুলিই শুধু উগরে দিচ্ছে, কিন্তু কি শিখছে সেটা তারা বলতে পারছে না। তারা
শিক্ষা থেকে কিছুই শিখছে না, কারণ সেগুলোর তারা মানেই জানে না ফলে তাদের জ্ঞানের
বিস্তার ঘটছে না।
বাংলার শিক্ষা সমীক্ষায় উইলিয়াম এডাম বলেছিলেন পাঠশালাগুলোয় যা পড়ানো হয় সব
ওপর ওপর এবং ত্রুটিপূর্ণ। সংস্কৃত কলেজে যে ব্যকরণ, আইন, অলঙ্কারশাস্ত্র,
যুক্তিবিদ্যা পড়ানো হয়, সেই পদ্ধতিটি উইলিয়াম ওয়ার্ডের মনঃপুত হয় নি, কেননা ১০০০
ছাত্রের মধ্যে মাত্র ৫জন বেদের দীর্ঘ সংস্কৃত সূক্তগুলো মনে রাখতে পারে এবং বেদের
দর্শন বিষয়েও খুব একটা জানে না।
তবে যে কজন ইওরোপিয় ভারতীয় পড়াশোনার পদ্ধতিটি নিয়ে বিপ্রতীপ মন্তব্য করেন নি
তাদের মধ্যে অন্যতম মাদ্রাজের আমিলা ফ্রান্সিস ডবলিউ এলিস। দক্ষিণ ভারতে বিচারক আর
কালেক্টর হিসেবে জীবন কাটানো এলিস প্রাচ্যবিদ হিসেবে প্রখ্যাত। ১৮১২ সালে
কোম্পানির সেন্ট জর্জে কলেজ স্থাপনের অন্যতম কারিগর। মাদ্রাজের কলেজ শুধু ব্রিটিশ
আর দক্ষিণ ভারতীয় ভাষাই শেখানো হত না, হিন্দু এবং মুসলমান আইনও পড়ানো হত। উত্তর
ভারতে কোম্পানির আদালতে হিন্দু এবং মুসলমানেদের পারিবারিক আইন নিয়ে কাজ হত, কিন্তু
তারা দক্ষিণ ভারতে এসে দেখল এখানকার ব্রাহ্মণদের অধিকাংশই ধর্মশাস্ত্র জানে না। মাদ্রাজ
প্রেসিডেন্সিতে হিন্দু আইন প্রয়োগ করার জন্যে যা কিছু শাস্ত্রীয় নিদানিয় পুথি
দরকার, তার একটা দীর্ঘ তালিকা তিনি তৈরি করলেন। তার প্রস্তাব ছিল কলেজের হিন্দু
ছাত্রদের জন্যে এইগুলি তামিল পদ্যে অনুদিত করা দরকার। তার বক্তব্য হল এগুলি যদি
তামিলে অনুবাদ করা যায় তাহলে তাহলে সেই ছাত্ররা ভারতীয়ত্ব সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করবে।
এলিসের যুক্তি ছিল, ভারতীয়দের পড়াশোনার পদ্ধতির জন্যেই আইন শেখানো খুব সুবিধের হবে।
তিনি বললেন ভারতের শিক্ষা পদ্ধতিতে এক্কেবারে তৃণমূলস্তর থেকে উচ্চতম স্তর পর্যন্ত
যুক্তিবিদ্যা আর ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে সব জ্ঞান আর বিজ্ঞান স্মৃতিতে ধরে রাখতেই হয়। এই
মনেরাখাকে তিনি গাছের মূল শেকড়ের(ট্যাপ রুট) সঙ্গে তুলনা করলেন, যার মাধ্যমে
পণ্ডিত বা ছাত্র সেই বিষয় ব্যখ্যা করতে, উদাহরণ দিতে পারে।
আদতে ব্রিটিশ যে ইওরোপিয় শিক্ষা পদ্ধতিকে স্বাভাবিক শিক্ষা পদ্ধতি হিসেবে গণ্য
করছিল এবং যে পদ্ধতি মার্ফত তারা ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি এবং জ্ঞানচর্চাকে অসম্পূর্ণ
হিসেবে দেগে দিচ্ছিল, ঠিক তার উল্টো পথে হেঁটে এলিস বললেন ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতি
ইওরোপিয় পদ্ধতির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা, একে ইওরোপিয় পদ্ধতি দিয়ে বিচার করা ঠিক হবে
না। ভারতীয় যুক্তির ভিত্তি আছে বলে এলিস লিখলেন, পদ্য আঙ্গিকের মাধ্যমে স্মৃতিতে
ধারণ করে রাখা ভারতীয় শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে জ্ঞানের নিষ্কর্ষই শিক্ষার্থীর
চেতনার গভীরে থাকে। তামিল ভাষায় যে পদ্য অনুদিত হল সেগুলির শিক্ষা ব্রাহ্মণদের
একচ্ছত্র আধিপত্য লোপ পাবে, এবং দক্ষিণ ভারতের শূদ্ররা যাতে পড়াশোনা না করতে পারে
তার জন্যে ব্রাহ্মণেরা সচেষ্ট ছিল এতদিন, এই জন্যেই তারা ধর্মশাস্ত্র পাঠ করতে
পারে নি। পদ্য ছন্দের অনুবাদ এবার থেকে বিচারালয়ে কাজে লাগবে এবং বিচারালয় আরও
ন্যায় পরায়ণ হয়ে উঠবে। এর জন্যে ব্রিটিশ বিচারকেদের তামিল শেখা জরুরি, যাতে তারা
তাদের তামিল আইন আধিকারিকদের সঙ্গে দাক্ষিণাত্যের স্বাভাবিক ভাষায় আলাপ আলোচনা
চালাতে পারেন।
No comments:
Post a Comment