অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
বস্ত্র এবং
কর্তৃত্বের সংবিধান
রেলরাস্তা বাড়তে
থাকার ফলে ভাইসরয়, তার বাহিনী, নানান স্তরের প্রশাসক এবং অন্যান্য উচ্চ পদাধিকারীরা
তার সঙ্গে এবং আলাদা করে ভারতে বেরাতে শুরু করে দিলেন অনেক বেশি মাত্রায়। কেন্দ্রিয়
সরকার এবং অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ সুবায় শীতকালীন এবং গ্রীষ্ম কালীন রাজধানী ছিল এই
সব রাজধানীতে প্রায়শই নানান ধরণের বৈঠক লেগেই থাকত এবং সেই বৈঠকে ইওরোপিয়
প্রশাসনিক আধিকারিকদের সঙ্গে দেশিয় অভিজাত, রাজা, জমিদার, বড় ব্যবসায়ী এবং সেনায়
কাজ করা নিম্নপদের আধিকারিকেরা যোগ দিতেন। রাজার জন্ম দিন, জুবিলি, সপ্তম এডওয়ার্ড
এবং পঞ্চম জর্জের সিংহাসনে আরোহন ইত্যাদি আয়োজন ভারতে এবং ইংলন্ডে সাম্রাজ্যের
গরীমা প্রকাশের অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে।
১৮৬৯ সালে সুয়েজ
খালে যাতায়াত চালু হয়ে যাওয়ার পর ভারত ইংলন্ডের মধ্যে যোগাযোগের সময় একমাসের বেশি
সময় কমে যায় এবং ভারতীয় অভিজাত রাজা রাজড়াদের ব্রিটেনে যাওয়া বাড়তে থাকে। ইংলন্ডে
ঘোরার মধ্যে থাকত ভিক্টোরিয়ার দরবার, উইন্ডসর বা তার কটেজ, আইসল অব ওয়েটের অসবোর্ন
হাউস ইত্যাদি। এখানে তিনি একটি দরবার ঘর তৈরি করেছিলেন অনুগত ভারতীয় অভিজাতদের
জন্যে। এই সব অনুষ্ঠানে কিন্তু ভারতীয়দের দেশিয় পোষাকেই উপস্থিত থাকার জন্যে
উৎসাহিত করা হত।
ওয়িয়েন্টালাইজিং
ইন্ডিয়া
স্টার ইন্ডিয়া
উপাধি এবং তার সঙ্গে জুড়ে থাকা উপহার আদতে ব্রিটিশ ভিক্টোরিয় সামন্ততান্ত্রিক অতীতের
স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যম। আদতে রাজতন্ত্রের মুখচ্ছবি আরও একটু উজ্জ্বল করে তোলা
এবং ব্রিটেনের যে একসময় খুব সহজ সরল অতীত ছিল, তারপরে তার সামাজিক, আর্থজিক এবং
রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে সেটাও উপনিবেশকে দেখানো উদ্দেশ্য ছিল এই উপহার দেওয়ার
চক্করে। দেখানোর চেষ্টা হল ব্রিটেনের স্বাধীনতা, তার আইনি ব্যবস্থা, এই আইনের শাসন
ইত্যাদির বিকাশ ঘটেছে শাসক আর শাসিতের মধ্যে চিরাচরিত স্বাভাবিক সম্পর্ক বিকাশের মধ্যে
দিয়ে। এটা খুব সরল সাধারণ স্মৃতিমেদুরতার থেকে অনেক গভীর, যা হয়ত খালি চোখে দেখা
যায় না। শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে(সব সময়ে সে অভিজাত নাও হতে পারে) জনগনকে বলার
চেষ্টা হল, প্রাযুক্তিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তনের যুগে রাজনৈতিক এবং সামাজিক
স্থিরতা বজায় রাখতে সুস্থিরতা, এবং হায়ারার্কি বজায় রাখা জরুরি।
ব্রিটেন এবং ভারত
উভয়েরই সামন্ততান্ত্রিক অতীত, বিশেষ করে ভারতে তখনও রাজারা ছিলেন আর ছিলেন বিপুল
সংখ্যক চাষী। বিভিন্ন ব্রিটিশ আমলা আর বিদ্বজ্জনেরা ভারতের যে সামাজিক বিকাশের পদ্ধতি
আর পথ নির্দেশ করছেন তাতে লুকিয়ে আছে একটা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য, বর্তমান ভারত
সমান ইওরোপিয় অতীত। ব্রিটিশদের হাতে ভারতের সার্বজনীন ইতিহাস তৈরি হওয়ায় ইতিহাসের নিয়ন্ত্রণ
চলে গেল ইওরোপিয়দের হাতে, সেটা সামন্ততান্ত্রিক, কিন্তু বর্তমানে সেই অবস্থা থেকে
সে বেরিয়ে আসছে। ব্রিটিশেরা শুধু ভারতের অতীত ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করল তাই নয়, সে
আগামি দিনের ইতিহাসও নির্দেশনার উদ্যম নিল, বর্তমানে ব্রিটিশদের ভূমিকা হল ভারত
শাসন।
ব্রিটিশদের
বদান্যতায় ভারতের উন্নতি নিশ্চিত এটা বলে দেওয়া গেল ঠারে ঠোরে নয় সরাসরিই। তারা
বলল ভারতের শাসক হয়ে এমন কিছু অবস্থা তৈরি করেছে যাতে ভারতের সামাজিক বিকাশ দ্রুত
হয় – যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তির ধারনার বীজ বপন, আধুনিক শিক্ষা, ইংরেজি ভাষা ভাবনা
এবং সাহিত্য, রেলরাস্তা তৈরি, সেচব্যবস্থা তৈরি, আধুনিক পয়ঃপ্রনালী এবং ওষুধ,
একনায়ক কিন্তু যুক্তিবাদী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসন আর ব্রিটিশ বিচার ব্যবস্থার বীজ
রোপণ। ব্রিটিশেরা জানত খুব তাড়াতাড়ি সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার
বিপদটা - মারাত্মক অরাজক অবস্থা, উচ্ছেদ এবং ভবিষ্যতে বৈপ্লবিক শক্তির বিকাশ ঘটা
এবং সেগুলোকে যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে অরাজক অবস্থা আরও বাড়া। তারা নিদান
দিল, এই বিপজ্জনক পরিনাম থেকে ভারতীয়দের বাঁচাতে ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে,
এবং তাদের নিজেদের ভালর জন্যে ব্রিটিশ পদ্ধতির যথোপযুক্ত চিন্তা প্রয়োগের ধারনায়
বিশ্বাস করতে হবে। ভারতের ভবিষ্যত উজ্জ্বল কিন্তু বর্তমানে যাতে খুব তাড়াতাড়ি
আধুনিক বিশ্বে প্রবেশের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্যে যে অরাজক অবস্থা তৈরি হবে তা এড়ানোর
জন্যে তাকে প্রাচ্যবাদে বিশ্বাস করতে হবে। ঠিক এই সময়েই ভারতীয় শাসকদের জন্যে
প্রাচ্যের পোষাক আর সেনার জন্যে প্রাতীচ্যের পোষাকের পরিকল্পনা তৈরি হল।
No comments:
Post a Comment