অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
বস্ত্র এবং
কর্তৃত্বের সংবিধান
মুঘল সম্রাট আকবর
আনন্দসহকারে নানান ধরণের পোষাকের আঙ্গিক এবং নিজেদের মধ্যে কথা বলার ভাষা তৈরি,
সম্মান দেখানোর নানান ভঙ্গিমা ইত্যাদি তৈরি করেছিলেন। সে সময়ের অন্যান্য শাসকের
মতই সম্রাট আকবর তার সাম্রাজ্যের সময়ে পরিধেয়, শস্ত্র এবং রত্ন্রাজির আলাদা আলাদা
গুদাম এবং রত্নাগার এবং হিসেব এবং ব্যবস্থাপনার দপ্তর তৈরি করেছিলেন। কর্মচারীরা
সেইগুলির হিসেবপত্তরও রাখত। কিছু জামাকাপড়ের মৌলিক চেহারারও বদল ঘটান আকবর। আবুল
ফজল লিখছেন, পরিধেয় এবং জামাকাপড় তৈরির কাজে সম্রাট অসাধারণ উৎসাহ দেখিয়েছেন।
সাম্রাজ্যের প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ শহরেই কাপড়ের কারখানা ছিল যেখানে প্রচুর
প্রখ্যাত দক্ষ কারিগর কাজ করতেন এবং আজ কাপড়ের যে সব আঙ্গিক, আকার, বৈচিত্র,
ফ্যাশন, বাঁধন অভিজ্ঞ ভ্রমনকারীদের চোখ পড়ে সেটা তার হাতেই বিকশিত হয়েছে। আকবর
সারা এশিয়া ইওরোপ এবং গোটা ভারত থেকে কাপড় জোগাড় কারবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তৈরি করার জন্য
নির্দেশ দেওয়া বা খোলা বাজার থেকে কেনা বস্ত্র এবং উপহার হিসেবে পাওয়া পরিধেয়
প্রত্যেক সপ্তাহের দিন এবং প্রত্যেক মাসের দিন চিহ্নিত করে, তার দাম, রঙ এবং ওজন
লিখে রেখে আলাদা আলাদা করে শ্রেণিবিভাগ করে আলাদা আলাদা করে রাখা হত দরবারে নিয়ে
যাওয়ার জন্যে। বস্ত্র আর পরিধেয়র আলাদা আলাদা শ্রেণীবিভাগ ছিল। ফারওয়াদিন মাসের
প্রথম দিনে যে বস্ত্রগুলি গৃহীত হত সেগুলি যদি উত্তমমানের হত, তাহলে সেগুলি উচ্চ
পদের জন্যে বরাদ্দ থাকত; সেই মানের অন্যদিনে প্রাপ্ত জামাকাপড়গুলি সেই মর্যাদা পেত
না; পরিধেয়গুলি যদি যদি একই মূল্যমানের হত তাহলে তাদের চরিত্র আর কোন দিন সেগুলি
প্রাপ্ত হয়েছে বা তার অন্যকোন শ্রেণীবদ্ধতা থাকত, সেই শ্রেণী অনুযায়ী সেগুলির মান
এবং তার কাজ নির্ণীত হত। দিনের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই অনেক কাপড় এলে হালকাগুলি
উচ্চপদাধিকারীদের জন্য বরাদ্দ থাকত; পরিধেয়গুলি যদি একই ওজনের হত তাহলে তাদের রঙ
অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ করা হত। লেখক ৩৯টা রঙ, যে রংগুলি ফুল ফল এবং পাখির নানান রঙের
সঙ্গে যুক্ত সেগুলির বর্ননা দিয়েছেন। কাপড়ের গুণমান আর আঙ্গিক এবং কাপড়ের ওপর
কাজের বৈচিত্র্য ছিল অসীম; তবে কাপড়ের ভাঁজ, কাটা এবং সেলাইয়ের মান এবং পদ্ধতির
বৈচিত্রও পরিধেয়র অন্যন্যতা তৈরি করত। ভারতীয় কাপড়ের যে উদ্ভাবনী শক্তি আর বিপুল
বৈচিত্র্য তৈরি করেছিল মুঘল আমল, তার একটা নিদর্শন পাওয়া যেতে পারে mattiebelle gettinger এর প্রদর্শনী থেকে।
আকবর তার
উত্তরসূরীর মতই কাপড় পরিধেয় এবং গয়নাগাটির বিশ্বে বাস করতেন এবং ফলে তিনি মুঘল
সমাজের নানান শ্রেণীতে কি ধরণের চিহ্ন প্রতীক গয়না কাপড়ের চরিত্র পরিহিত হবে তার
বিশদ নীতি ঠিক করে দিয়ে যান। উনবিংশ শতকে ব্রিটিশ যখন সারা ভারত এবং রাজাদের ওপরে
তাদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করছে, তারা সেই সার্বভৌমত্বের চিহ্নগুলির সরলীকরণ করে ফেলল
এবং নিজেরাই সার্বভৌম হিসেবে গেড়ে বসল।
সম্মানের পরিধেয় রূপান্তরিত
হল আংরাখার অধীনতায়
মুঘল দরবারে
প্রথম ব্রিটিশ টমাস রো’র ভ্রমণ থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য পর্যন্ত খেলাতের গুরুত্ব
কমে নি। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কোম্পানি সামরিক শক্তি যতই বাড়তে থাকে,
ব্রিটিশেরা সম্রাটের নিরাপত্তায় ব্যবসা করা সওদাগর থেকে ক্রমশ রাষ্ট্রনির্ভর সামরিক
শক্তিতে রূপান্তরিত হচ্ছিল। এই পদ্ধতিতে কোম্পানির ব্রিটিশ আমলারা মুঘল উপাধি আর
খেলাতে সম্মান পেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। বাংলা সুবায় কোম্পানির কর্মকর্তারা
ভারতীয় সার্বভৌমতার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করায়, তারাও তাদের ভারতীয় অধীনস্থদের খেলাত
দেওয়ার প্রথা চালিয়ে যায় এবং তাদের প্রভাব ব্যবহার করে মুঘল দরবার থেকে তাদের সাথী
আর কর্মচারীদের জন্যে নানান ধরণের সুযোগ সুবিধা উপাধি সম্মান জোগাড় করে নিয়ে আসতে
থাকে। উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে, ভারতে বেড়াতে আসা ধনী এবং অভিজাত ব্রিটিশদের
প্রথাই হয়ে গিয়েছিল দিল্লিতে গিয়ে মুঘল সম্রাটের সঙ্গে দেখা করে আসা এবং তাঁর হাত
থেকে সম্মান নেওয়া। ভারতের সেনা প্রধান লর্ড কম্বারমিয়র ১৮২৭ থেকে ১৮২৯ পর্যন্ত
যখন উত্তর ভারতে সমীক্ষা ভ্রমণ করছিলেন তার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন মুনডি। তারা তখন
দিল্লিতে। নজর এবং খেলাত পাওয়া ভ্রমণের অঙ্গ হিসেবে ধরা ছিল।
No comments:
Post a Comment