অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
রাষ্ট্র এবং অতীত ভারত সমীক্ষা
১৭৯৯ শ্রীরঙ্গপত্তনমের টিপু সুলতানের হারের সঙ্গে সঙ্গে
কোম্পানি সরকার পদ্ধতিগতভাবে গুরুত্ব দিয়ে ভারতের অতীতে ঝুঁকে দেখার সিদ্ধান্ত
নিল। প্রায় ৫০ বছর আগে পলাশীতে যুদ্ধের জয় দিয়ে কোম্পানির ভারত শাসন শুরু হয়েছিল,
টিপুর হারে তার সঙ্গে যুক্ত হল দাক্ষিণাত্য এবং বিন্ধ্যাচলের অধিকাংশ এলাকা। ১৮০৩এ
লর্ড লেকের দিল্লি প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে এই জিত আলেক্সান্ডারের ভারত জয়ের ঐতিহাসিক
স্বপ্ন পূর্ণ করল। ইওরোপের তৈরি ভারত ইতিহাসে টিপুকে ভিলেন তৈরি করে ব্রিটিশ
নিজেকে বির্যবান, ধর্মাচারী, সব থেকে বড় কথা, বিজয়ী শিবির হিসেবে চিহ্নিত হল।
কোম্পানি শাসক ওয়েলেসলি তার সময়ে সাম্রাজ্যের দায় পূরণ
করেছেন। কোম্পানির লন্ডনের কর্তারা লাভ ক্ষতির হিসেবের বাইরে খুব বেশি নজর দিতেন
না, কিন্তু ওয়েলেসলির ভবিষ্যতের সাম্রাজ্য পরিকল্পনা ভারতে আসার আগেই ছকে
নিয়েছিলেন। তিনি যে কলেজ তৈরি করলেন, সেখানে ছাত্ররা শুধু কোম্পানির হিসেব রাখার
বাইরেও কোম্পানির সার্বভৌম সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে তৈরি করবে। এর পাশাপাশি
ওয়েলেসলি নতুন বিজয়ী এলাকা বিশেষ করী দাক্ষিণাত্যের সামাজিক ধনসম্বল, শিল্প
সাহিত্য, উতপাদন নিয়ে সমীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই উদ্দেশ্য পূরণে জন সিনক্লেয়ারের
স্কটল্যান্ডীয় সমীক্ষার মডেল অবলম্বন করলেন।
অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং উনবিংশ শতকের শুরুতে, সঙ্খ্যাতত্ত্বকে
আজকের হিসেবে সাংখ্যিক নানান তথ্য সংগ্রহ হিসেবে না দেখে, দেখতে হবে রাষ্ট্রের
উপযোগের জন্যে আহরিত তথ্যতত্ত্ব হিসেবে। উইলিয়াম ক্যামডেনের(১৫৫১-১৬২৩)এর সময় থেকে
ততকালীন সময়ের ব্রিটেনের অবস্থা, ইতিহাস এবং স্থানীয় অঞ্চলের প্রাগৈতিহাসিকতা
বিষয়ে তিথ্য সংগৃহীত এবং প্রকাশিত হচ্ছিল। এই উদ্যমের কেন্দ্রউদ্যম হিসেবে পুরোনো
স্থাপত্যগুলির অবস্থান এবং ইতিহাস, খণ্ডহরগুলির ইতিহাস, পুরোনো বসতির
প্রত্নতত্ত্ব, প্রতিষ্ঠিত পরিবারগুলোর ইতিহাস ও বংশলতিকা, স্থানীয় নানান ধরণের
পুরোনো প্রথা আর আইন এবং নানান কিছু উদ্ভট সব তথ্য নথিকরণ করা চলছিল।
মহীশূর অঞ্চলের তিনটে সমীক্ষা করা শুরু করলেন ওয়েলেসলি,
একটা দিলেন কর্নেল ম্যাকেঞ্জির দায়িত্বে, আঙ্কিক আর প্রাকৃতিক বিষয় মাথায় রেখে।
আরেকটার দায়িত্ব পেলেন ফ্রান্সিস বুকানন হ্যামিলটন, যাকে ওয়েলেসলির কাছে আনা
হয়েছিল ভারতের কৃষি বিষয়ে সমীক্ষার আগ্রহের জন্যে আর তৃতীয়টার দায়িত্ব পেলেন
বেঞ্জামিন হেইনস, যিনি ম্যাকেঞ্জির অধীনে ভৌগোলিক আর গাছগাছড়া নিয়ে সমীক্ষা করবেন।
ম্যাকেঞ্জির জীবনের প্রথম ২৮ বছরের কোন বিশদ হিসেব পাওয়া
যায় না। হেব্রাইডিসের আইসলস অব লিউইসের স্টর্নোটিতে তার জন্ম। বাবা ব্যবসায়ী।
দ্বীপপুঞ্জের মালিক সিফোর্থদের সঙ্গে পারিবারিক পরিচয় ছিল। অঙ্কে ব্যাপক মাথা ছিল
তাঁর, ব্রিটিশ লগারিদমের স্রষ্টা, মার্কিস্টনের নেপিয়ারকে সহায়তা করেন। নেপিয়ারের
হিন্দু অঙ্কে উৎসাহেই তিনি ১৭৮৩তে তিনি মাদ্রাজের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে যোগ দেন।
১৭৮২ সালে ভারতে এসে কাজে যোগ দেওয়ার আগে মাদুরাইতে হিন্দু
অঙ্ক বুঝতে ও নথি করার কাজে রত বহু ব্রিটিশের সঙ্গে লর্ড মার্কিস্টনের কন্যার
সঙ্গে কাজ শুরু করেন। কিন্তু হিন্দু আচার আচরণ এবং ভূগোল আর ইতিহাস নথিকরণের উৎসাহ
থাকলেও, বেশিদিন সেই কাজটি চালিয়ে যেতে পারে নি সরকারি কাজের দাবিতে। তিনি কৃষ্ণা
নদীর দক্ষিণ দিকের অঞ্চলের সরকারি কাজে লেগে যান এবং নিয়মিত বদলির জন্যে স্থানীয়
ভাষা শিক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। বিভিন্ন বস্তুর পদ্ধতিগত সময় সাপেক্ষ
সমীক্ষা, এবং বিভিন্ন প্রথা এবং সঙ্গঠনের বিষয়ে জানার ইচ্ছের পরিসমাপ্তি ঘটল।
১৭৯৬ সালে পরিচয় হয় তেলুগু ব্রাহ্মণ কাভেলি ভেঙ্কটা বোরিয়া।
ম্যাকেঞ্জি তার ভারতীয় জ্ঞান সংগ্রহের সব শ্রেয় এই ব্রাহ্মণকে দিয়েছেন। বোরিয়া
কুড়ি বছর বয়স থেকে তার কাছে কাজ করা শুরু করেন। তিনি এবং বিপুল সংখ্যক ভারতীয় ম্যাকেঞ্জির সঙ্গে
বহুকাল ধরে কাজ করেন। তার প্রাথমিক কাজ ছিল দোভাষীর এবং দক্ষিণভারত জুড়ে যখন ম্যাকেঞ্জি
বিভিন্ন পুথি, লেখ, হাতিয়ার এবং অন্যান্য ঐতিহাসিক এবং সামাজিক তথ্যাবলী জোগাড়
করছিলেন, সেই কাজে যুক্ত দেশিয় জ্ঞানীদের পরিচালনা করা। সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় যে
বিপুল ভৌগোলিক এলাকার জমির মাপ এবং ভূসংস্থানগত সমীক্ষার কাজের ভার ম্যাকেঞ্জি নেওয়ার
ফল হয়েছিল তিনি ভারতের সার্ভেয়ার জেনারেল পদে বসেছিলেন। বোরিয়া কুড়ি বছর বয়সে শুধু
যে তামিল তেলুগু জানতেন তাই নয়, তিনি সংস্কৃত, ফারসি, হিন্দুস্থানী, এবং ইংরেজিও শিখেছিলেন।
ষোল বছর বয়সে জনৈক ব্রিটিশের অনুবাদক এবং করণিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৮০৩ সালে
ছাব্বিশ বয়সে মৃত্যুর সময়ে ম্যাকেঞ্জিকে মন্দির লেখ, পুরোনো লিপি, পুথি, তথ্য ও বই
অনুবাদে সাহায্য করেন। বোরিয়ার ভাই কাভিলি ভেঙ্কটা রামস্বামীর দেওয়া তথ্যানুসারে
সংস্কৃত আর তেলুগুতে কবিতা লেখা ছাড়াও শ্রীরঙ্গপটতনমের পতন নিয়েও প্রবন্ধ লেখেন
বোরিয়া।
No comments:
Post a Comment