অধ্যায়২
শিক্ষা এবং অতীত সংরক্ষণ
১৭৮০ সালের সেপ্টেম্বরে কিছু শিক্ষিত এবং সুনামী মুসলমান ওয়ারেন হেস্টিংসের
সঙ্গে দেখা করে যুবাদের জন্যে মুসলমান আইন এবং অন্যান্য বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য একটি
মাদ্রাসা স্থাপনের আর্জি জানান। এই বৈঠকটা আয়োজিত হয়েছিল প্রখ্যাত জ্ঞানী
মুইজউদ্দিনএর কলকাতা ভ্রমনের সম্মানে। সম্মানিত ব্যক্তিরা ধারণা করছিলেন হেস্টিংস
জনাব মুইজউদ্দিনকে এই মাদ্রাসার নির্দেশকের পদ দেবেন। জ্ঞানীদের আর্জিতে মাদ্রাসা
স্থাপন এবং তার খরচ বহনে রাজি হয়েও তিনি এই ধরণের শিক্ষা কেন্দ্রের দুর্গতিময়
ভবিষ্যত নিয়ে বললেন, আমি এই ধরণের ক্ষয়িষ্ণু বিদ্যালয় হিন্দুস্থানের রাজধানী সহ
বিভিন্ন শহরে দেখেছি। প্রখ্যাতদের সঙ্গে বৈঠকে হেস্টিংস আশা করলেন কোম্পানির
তহবিলে চলা কলকাতা মদ্রাসা কোম্পানির জন্যে আইন আধিকারিক সরবরাহ করে কোম্পানির নাম
উজ্জ্বল করবে এবং বাড়তে থাকা ব্রিটিশ ক্ষমতার বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত
করবে।
মুইজউদ্দিনের নির্দেশনায় কলকাতা মাদ্রাসার যাত্রা খুব ভালভাবে শুরু হল নব্বই
জন ছাত্র এবং অনেকগুলি বিভাগের সমন্বয়ে। কয়েক বছরের মধ্যেই মৌলভির বিরুদ্ধে সরকারি
বরাদ্দকরা তহবিল তছরূপ, স্বজনপোষণ এবং ছাস্ত্রদের আস্থা হারানোর মত গুরুতর অভিযোগ
উঠল। মৌলভিকে পদচ্যুত করে কলেজের প্রশাসন চালাবার জন্যে কিছু ব্রিটিশ আমলা নিযুক্ত
হল। সব থেকে বড় ব্যাপারটা হল যদিও পাঠ্যকেন্দ্রের বিষয়গুলি ইসলামি জ্ঞানচর্চাই
থাকল কিন্তু পড়াশোনার পদ্ধতিটি ইওরোপিয় পন্থায় ঢেলে সাজানো হল।
বেনারসের সংস্কৃত কলেজের ইতিহাসও প্রায় একই ধাঁচের। বেনারসের রেসিডেন্ট জোনাথন
ডানকান প্রথম কলেজটি শুরু করেন। তার প্রস্তাব ছিল কোম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের
ফলে উদ্বৃত্ত রাজস্বের একটি অংশ ব্যবহার করে হিন্দুদের বিশ্বাস মত হিন্দু আইন,
সাহিত্য এবং ধর্মচর্চার জন্যে একটি হিন্দু কলেজ স্থাপন করা। ডানকানের মতে এই
সংস্থাটি তৈরি হলে আমাদের সাম্রাজ্যের প্রতি দেশিয়দের আস্থা বাড়াবে। বহু কাল ধরেই বেনারসে
প্রচুর এই ধরণের ব্যক্তিগত উদ্যোগে জ্ঞানচর্চার পীঠস্থান ছিল, যেখানে নানান ধরণের
হিন্দু বিষয় পড়ানোও হত। কিন্তু তার প্রস্তাবিত এই শিক্ষাকেন্দ্রটি যে ব্যতিক্রমী হবে
তা তিনি শুরুতেই বুঝিয়ে দিলেন। এটি হবে দেশের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রমী সরকারি
উদ্যম। যেটি এই কাজের জন্যে সম্পূর্ণভাবে নিবেদিত হবে, ফলে কোম্পানির সম্মানও
বৃদ্ধি পাবে। যোগ্য শিক্ষকদের এই সঙ্গঠনে যুক্ত করা ছাড়াও ডানকান বলনেন হিন্দু স্মৃতি,
শিল্প বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক এবং শুদ্ধ শাস্ত্রাদির গ্রন্থাগার খুব বেশি খরচ
ব্যতীতই গড়ে তোলা যেতে পারে।
হয়ত কলকাতা মাদ্রাসার অভিজ্ঞতার নিরিখেই ডানকান কয়েকটি নির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন
করলেন, যেখানে গভর্নর জেনারেলের প্রতিনিধি হয়ে রেসিডেন্ট, সরকারি ব্যয়ে পঠন
সম্পন্ন করা ছাত্রদের জলপানি হস্তান্তর করবেন, শিক্ষক নিযুক্ত এবং বরখাস্ত করার
অধিকার থাকবে, ছাত্রদের বহিষ্কার করারও ক্ষমতা থাকবে। ত্রৈমাসিক পরীক্ষায় ডানকান
উপস্থিত থাকতেন, বিশেষ করে সেই সব বিষয় যেগুলি পবিত্ররূপে গণ্য হত না; পবিত্র বিষয়গুলির
পরীক্ষার জন্যে তিনি ব্রাহ্মণদের দল তৈরি করে দিতেন যারা এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে
এই পরীক্ষাগুলি নিতেন। স্থাপনের দশ বছরের মধ্যেই আর্থ তছরূপ, স্বজনপোষণ ইত্যাদির
অভিযোগে সংস্কৃত কলেজের মাদ্রাসার গতি হয়।
কলকাতায় মাদ্রাসা এবং বেনারসে সংস্কৃত কলেজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় বৃহত্তরভাবে
ঔপনিবেশিক আমলে, উপনিবেশের দেখাশোনায় উপনিবেশের আর্থে চলা সঙ্গঠন ব্যবস্থাপনার
একটা বিশেষ ইঙ্গিত বহন করে। ব্রিটিশদের ধারণা ছিল তারা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থার
সূচনা করবে যেটি একটি কেন্দ্রে পঠিত হবে, অর্থাৎ কোন বিদ্যালয়ের কাঠামোয় একটি
শ্রেণী থেকে অন্য শ্রেণীর মধ্যে দেওয়াল তুলে ছাত্রদের আলাদা করে আর শিক্ষকদের
সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে বিভেদ আর বিভাগ তৈরি করে। এইসব বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট অধ্যক্ষ,
শিক্ষক এবং সহকারির পদ তৈরি হল যারা ছাত্রদের নির্দিষ্ট বিষয়, নির্দিষ্ট ক্লাসে,
নির্দিষ্ট সময়েই পড়াতেন। ছাত্রদের পঠনপাঠনের, জ্ঞানের অগ্রগতি সূচিত হত নির্দিষ্টভাবে
নেওয়া পরীক্ষার মাধ্যমে। এই প্রক্রিয়াটি শেষ হত ছাত্রদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের একটি
নির্দিষ্ট শংসাপত্র এবং উপহার দেওয়ায়। হেস্টিংস, ডানকান এবং অন্যান্যদের হাজারো
উদ্যম ও সদিচ্ছা সত্ত্বেও ব্রিটিশ মেটালজিকে নিয়মনিষ্ঠা, সঙ্গতি, এবং সর্বোপরি
আর্থিক দায়দায়িত্বও এই সঙ্গঠনগুলিকে দুর্নীতির কবল থেকে বাঁচাতে পারে নি, বরং দিনে
দিনে ব্রিটিশ যা সংরক্ষণ করতে চেয়েছিল – হিন্দু আরে মুসলমান জ্ঞানচর্চা, সেটি ধ্বংসপ্রাপ্ত
হয়েছে।
No comments:
Post a Comment