অধ্যায় ৩
আইন এবং ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র
হেস্টিংস এবং পরম্পরার কর্তৃত্ব এবং শাসনের নতুন সংজ্ঞা
বহুকাল ভারতে কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ দেখা এবং রাজনৈতিক দৌত্য করা ওয়ারেন
হেস্টিংসকে ১৭৭২ সালে নতুন পার্লামেন্টারি আইন মোতাবেক গর্ভনর জেনারেলের পদ তৈরি
করে কোম্পানির কোর্ট অব ডিরেক্টর্স বাংলায় প্রশাসক হিসেবে পাঠালো যাতে তিনি বাংলা
ভূখণ্ডে ব্রিটিশ শাসনের শেকড় গভীরে প্রথিত করতে পারেন। একদিকে ভারতীয়(বলা দরকার
বাংলা ভূখণ্ডের) জটিলতা আর অন্যদিকে নীতি নৈতিকতা বিসর্জন দেওয়া প্রশাসন সামলানো তার
কর্তব্য হয়ে দাঁড়াল। ১৭৫৭র পরে বাংলায় কোম্পানির আমলাগিরির অর্থ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল
খুব তাড়াতাড়ি অমিত ধনী হয়ে ব্রিটেনে ফিরে এসে জমিদারি কিনে আরামে দিন যাপন।
হেস্টিংসের আরেকটি সমস্যা ছিল দুর্বহ ব্রিটিশ সরকার তার মাথায় পাঁচজনের একটি
কাউন্সিল বসিয়ে দিয়েছিল সে দলে হেস্টিংস অবশ্যই প্রধান ছিলেন(কিন্তু সেই দলের
নিয়ন্ত্রণ তার হাতে ছিল না)।
বাংলাকে ভাল প্রশাসন দিতে হেস্টিংসের পরিকল্পনা ছিল মুঘল আমলের প্রশাসনিক
বিভাগ, একটি সুবার বিভিন্ন সরকারে প্রত্যেকটিতে একজন করে ব্রিটিশ কালেক্টর নিয়োগ
করা। এই কালেক্টরদের প্রশাসনিক আর বিচারের যৌথ দায়িত্ব অর্পণ করা হল। হেস্টিংস
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাসে এমন একটি পদ তৈরি করলেন, যে পদটি আফ্রিকা,
দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং দক্ষিণ পশ্চিম প্যাসিফিক অঞ্চলের ঔপনিবেশিক প্রসাসনের অঙ্গ
হয়ে পড়বে। এই পদে প্রশাসকটির মানুষটির দায় হল (সাম্রাজ্যের দৃষ্টিতে) স্থানীয়দের
জানা এবং সেখানে সামরিক বা পুলিশি বল নিয়ে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা।
হেস্টিংসের পরিকল্পনার মূল ভিত্তি ছিল গোটা সপ্তদশ শতক ধরে মুঘলদের কার্যকর
প্রশাসনিক কাঠামোটি - অবশ্যই ইওরোপিয় নীতিতে নয়, বরং ভারতীয় চরিত্র, তত্ত্ব ও
প্রথা অনুসারে। তিনি জানতেন বিগত পঞ্চাশ বছরে যুদ্ধ-বিগ্রহে দীর্ণ হয়ে, প্রশাসনিক
দুর্নীতিতে এবং সাম্রাজ্যের প্রতিস্পর্ধী স্থানীয় জমিদারদের উত্থানে এবং সরকারি
সেবাগুলোর বেসরকারিকরণের ফলে বাংলার প্রশাসনিক কাঠামো চুর চুর হয়ে ভেঙ্গে পড়েছে।
ওয়েস্টমিনটারের সেরা ছাত্র হেস্টিংস ধ্রুপদী পশ্চিমি ইওরোপিয় শিক্ষায় শিক্ষিত।
তার চাকরির প্রথম পনের বছর চাকরি জীবনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় – যদিও তিনি
এই সময়ে কোম্পানির ব্যবসাবাণিজ্য বিষয়েইয় দায়িত্বে ছিলেন, কিন্তু এই সময়ে তিনি
মধ্যবাংলায় শেষ নবাবদের দরবারে দেখছিলেন পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চোখের সামনে।
তিনি বুঝেছিলেন কিভাবে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা চলে। সেই সময় তার মনে হয়েছিল ভারতীয়
শাসকদের সম্বন্ধে ব্রিটিশেরা যে সব কুৎসা করে যেমন নবাবের একনায়ক, দুর্নীতিপরায়ণ
এবং অত্যাচারী – এগুলো সম্পূর্ণ সত্যি নয়। তার বিশ্বাস ছিল দীর্ঘ দিন ধরে হিন্দু
আর মুসলমান প্রশাসনিক জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা ব্রিটিশ ভারতে প্রশাসন বিকাশে কাজে লাগতে
পারে।
ইংরেজিতে অনুদিত প্রথম দিককার ফারসি টেক্সট ছিল আবুলফজলআলামির আইনিআকবরি – মুঘল
আমলের সব থেকে বর্ণময় চরিত্র আকবরের সময়কালের প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দলিল। এটি কিছুটা
নির্দেশমূলক আর কিছুটা বর্ণনামূলক ভাবে লেখা হয়েছে। কিভাবে মুঘল সরকার, দরবার এবং
প্রশাসন চালিত হবে তার মূল নির্দেশনামা এই বইতে লিখিত আছে। এছাড়াও এই বইতে লিখিত
হয়েছে যোগ্য প্রশাসক হতে গেলে কোন গুণগুলো দরকার, সম্রাটের সঙ্গে কোন কোন পশু
থাকে, কিভাবে তাঁবু পাততে হয়, কিভাবে গয়নাপত্রের চরিত্র নির্ধারণ করা হয় ইত্যাদি। এই
বই ব্রিটিশদের আকর্ষণ করেছিল কারণ, এখানে রাজস্ব আদায়ের জন্য বাস্তবিক প্রশাসনিক
এবং বিচার ব্যস্থার কাজকর্ম আর ‘জমা কামেল তুমহারি’ বা রেন্ট রোল বিশদভাবে লিখিত হয়েছে।
No comments:
Post a Comment