অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
ফারগুসন স্পষ্ট
করে বলছেন এবং ঠিকই বলছেন, যে পৃষ্ঠভূমিতে ভারতের ইতিহাস রচনার উদ্যম নেওয়া
হয়েছিল, সেটা আদতে একটা রাজনৈতিক উদ্যোগ, আইনের চোখে সমানাধিকারের দাবি শুধু নয়, ভারতের
ইতিহাস এবং পরম্পরা এবং অতীত কিভাবে উপস্থাপিত হবে সেটাও উঠল সমানভাবে।
এই অধ্যায়ে আমরা
দেখলাম, কলিন ম্যাকেঞ্জি কিভাবে তার সংগ্রহ তৈরি করে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক খনন
এলাকাকে নিজের মত করে বোঝার চেষ্টা করছেন। তবে হাস্যকর হল, অমরাবতী স্থাপত্যগুলি ক্যাটালগিং
করতে অপেক্ষা করতে হল কিন্তু ১৯৪২ সাল পর্যনন্ত। সে বছর সি শিবরামমূর্তি
প্রত্যেকটা মূর্তির আইকনোগ্রাফি আর বিশদ বিবরণ লিখিতভাবে তৈরি করে প্রকাশ করেন। ১৯৫৪
সালে ডগলাস বারেট ব্রিটিশ মিউজিয়ামের সংগ্রহগুলি নিয়ে আলোচনা করেন। মিউজিয়ামের ওরিয়েন্টাল
এন্টিকুইটির ভারপ্রাপ্ত বাসিল গ্রে বললেন, অমরাবতী মূর্তিগুলি মিউজিয়ামের সব ভাল
কাজ যেমন এলগিন মার্বেল আর এবং সিরিয় রিলিফের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনীয়। ফলে
স্থাপত্যগুলির ইতিহাস বিচার করে অবাক হয়ে দেখলাম, ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অমরাবতীর যে
স্থাপত্যগুলি মর্যাদা পায় নি সেগুলোর ভাগ্য কি হল আমরা জানি না! শেষমেশ দেখা গেল
অমরাবতী স্থাপত্যগুলি আর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে দেখা যায় নি।
কোম্পানির শিল্প,
শিল্পবস্তু এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে আমলাদের ধারণা ছিল এলোমেলো এবং মিথ্যা ধারনায়
পরিপূর্ণ। ব্যক্তিগত স্তরে অনেকেই উদ্যম নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু লেডেনহল স্ট্রিটের
হিসাবরক্ষকেরা যখন সেগুলির বাজার মূল্য বুঝতে পারত এবং হিসাবের খাতায় বিপরীত
প্রভাব পড়ার আশংকা করত, তখন সব কাজ আটকে যেত।
তবে ভারতীয়
শিল্পসাহিত্য আর ইতিহাস পাঠের প্রাতিষ্ঠানিক এবং পদ্ধতিবদ্ধ শিক্ষাপ্রণালী তৈরি
করল ওয়েলেসলির প্রশাসন, যিনি প্রথম সাম্রাজ্যের দৃষ্টিতে ভারত শাসন করেছিলেন, যিনি
কোম্পানির সর্বেসর্বা সংগঠন কোর্ট অব ডায়রেক্টর্সএর অনুমতি ভিন্নই কলেজ অব ফোর্ট
উইলিয়ম, সাধারণের ভাষায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপন করেন। এই কলেজে ভারতীয় এবং
পশ্চিমি উদারপন্থী জ্ঞানচর্চার ধারা যুবা আমলাদের পড়ানো হতে থাকে। এখানে
গুরুত্বপূর্ণ হল ভারতীয় ভাষা এবং সাহিত্যের পদ্ধতিবদ্ধ পড়ানোর প্রথম উদ্যম নেওয়া
হল, ব্রিটিশ এবং ভারতীয় প্রখ্যাত জ্ঞানীদের কাজে লাগিয়ে। যতদিন কলেজ টিকে ছিল,
ততদিন, শিক্ষকদের সম্মানজনকভাবে সাম্মানিক দেওয়া নিয়ে এবং শুধু ছাত্র পড়ানো ছাড়াও
শিক্ষকদের শিক্ষা সহায়ক নানান মেটিরিয়াল তৈরি করছেন না কেন সেই প্রশ্ন নিয়ে
শিক্ষকদের সঙ্গে প্রশাসকদের বিরোধ বেধেছে। ১৮০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি আমলা
তৈরির হ্যালিবেরির কলেজ, যার উদ্দেশ্য ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের খরচ কমানো,
সেখানেও একই সমস্যা দেখা দিয়েছে।
তবে ১৭৮৫ সাল
থেকে দীর্ঘকাল ধরে যে সংগঠন একইভাবে জ্ঞান নথিকরণ এবং ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছে, তার
নাম এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল। এটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ, কিন্তু সরকারের সঙ্গে
ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করে গিয়েছে। এই সঙ্গঠনের সদস্য পদ নিতেন সবসময় গভর্নর জেনারেল যিনি
সঙ্গঠনের সাম্মানিক সভাপতি হিসেবে কাজ করতেন। প্রায়শঃই এই সংগঠন সরকার থেকে সরাসরি
দান পেয়েছে, এবং ভারতীয় প্রাচীনত্ব, ইতিহাস এবং প্রাকৃতিক ইতিহাসের বিকাশ নিয়ে যে
সব জ্ঞানচর্চা, সেগুলির সন্দেহ নিরসনের জন্যে সরকার সিমিতিকে দায়িত্ব দিতেন।
অষ্টাদশ শতকে এবং
উনবিংশ শতকের শুরুতে বিভিন্ন পুঁথি, ছবি, মূর্তি, হাতিয়ার, এমন কি জীব ও প্রাণী
বৈচিত্রের নানান নমুনা সংগ্রহের কাজ হয়েছে, এবং যার অধিকাংশই ব্রিটিশ মিউজিয়ামে
প্রদর্শিত হয়েছে, তার অধিকাংশই ব্যক্তিগত উদ্যোগে করা হয়েছে, যেগুলি পরবর্তী কালে
সরকারকে তাঁরা দিয়ে দিয়েছেন বা সরকার কিনে নিয়েছে। ১৭৩০ থেকে ১৭৪০ পর্যন্ত সুরাটে
কোম্পানির ব্যবসায়ী, নাদির শাহের ইতিহাস রচয়িতা বিপুল পরিমান সংস্কৃত পুথি সংগ্রহ
করে অর্থ নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলিও তিনি নিজের দেশে নিয়ে যান। মৃত্যুর পর
তাঁর বিধবা সেই সংগ্রহ অক্সফোর্ডের র্যাডক্লিফ লাইব্রেরিকে বিক্রি করে দিয়ে যান,
সে সংগ্রহ পরের দিকে বোদলিয়ানে স্থানান্তরিরত করা হয় এবং যার ভিত্তিতে লাইব্রেরির সংস্কৃত
মহাফেজখানা গড়ে ওঠে।
No comments:
Post a Comment