অধ্যায় ৫
বস্ত্র, পরিধেয় এবং উপনিবেশিকতাবাদঃ উনবিংশ শতকের ভারত
পরিচিতির চিহ্ন
হিসেবে পাগড়ি
শিখ যুদ্ধে জেতার
এক বছরের মধ্যে ব্রিটিশ শাসকেরা শিখদের সেনা বাহিনীতে নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে
দেয়। যে সব যোদ্ধা আমলা শিখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, তারা বলল কেশধারী শিখদের
রেজিমেন্ট বানানো দরকার, খালসা শিখ যারা মাথার চুল ছোট করে না, তাদেরই একমাত্র
বাহিনীতে নিতে হবে – কারণ তারা সহি শিখ। যে সব শিখকে, শিখদের মত দেখতে – যারা আদিম
চেহারার, চুল দাড়ি কাটে না, তারাই সেনাবাহিনীর চাকরিতে যোগ্য বলে বিবেচিত হবে। শিখদের
ক্ষেত্রে সরকারি নীতি হল তাদের জাতিবাদিতার ওপর সরকার হস্তক্ষেপ করবে না... তাদের
ধর্মীয় এবং সামাজিক চরিত্র বজায় রাখার চেষ্টা হবে।
১৮৫০ সালে শিখ
রেজিমেট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিপাহী যুদ্ধে ব্রিটিশদের সেনাবাহিনীর বিপুল
অংশ বিদ্রোহ করলেও, শিখেরা মহা উৎসাহে তাদের শত্রু মুঘল সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে
হারিয়ে দেয় গাঙ্গেয় উপত্যকা জুড়ে।
১৮৬০ সালের পরের
দিকে ব্রিটিশেরা প্রাথমিকভাবে পাঞ্জাবী, বিশেষ করে শিখ বাহিনীর ওপর খুব বেশি ভরসা
করতে থাকে। ১৯১১ সালে ভারতের জনসংখ্যার ৮ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবের অর্ধেক
জনসংখ্যা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত হয়। শিখেরা ভারতের জনসংখ্যার ১ শতাংশ হলেও,
সেনাবাহিনীর ২০ শতাংশ সেনা ছিল শিখ।
উনবিংশ শতকের
শেষের দিকে শিখেদের পাগড়ি অন্যান্য সমাজের যেমন পাঞ্জাবি মুসলমান বা হিন্দু
ডোগরাদের পাগড়ির থেকে আলাদাভাবে সেজে উঠল। এবং পাগড়ি ব্রিটিশ সেনার শিখ
রেজিমেন্টের অন্যতম চিহ্ন হয়ে উঠল। শক্তকরে কাপড় দিয়ে গোটা মাথা আর কান ঢাকা পাগড়ি
পরা শিখদেরই ব্রিটিশেরা তাদের ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীতে নিযুক্ত করতে শুরু করে। শক্তকরে
মাথায় বাঁধা পাগড়ি এবং সুন্দর করে ছাঁটা দাড়িওয়ালা শিখেরা ১৯৪৭ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর
অন্যতম চেহারা হয়ে ওঠে; এদের অবাধে নেওয়া হতে থাকে এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে থাকে –
তাদের বন্যতা নিয়ন্ত্রিত হত পাগড়িদ্বারা; তাদের অমিত ভয়হীনতাকে শ্বাপদের মত
সাহসিকতাপূর্ণ করে তোলা অবিচলিত ভবলেশহীন বৃষদের মত অনুগত থাকার ইচ্ছাশক্তিকে
পরিণত করা হল আদেশ দেওয়া ব্রিটিশ আমলা যোদ্ধাদের প্রশ্নহীনভাবে মান্য করতে।
প্রথম
বিশ্বযুদ্ধে, ব্রিটিশেরা তাদের বাহিনীর নানান ঔপনিবেশিক সমাজ থেকে তৈরি হওয়া দলের
পরিধেয় পাগড়িকে প্রতিস্থাপিত করে ইস্পাতের হেলমেট দিয়ে, কিন্তু ততদিনে পাগড়ি
শিখেদের ধর্মের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয়ে জুড়ে গিয়েছে, এবং তখন যদি কেউ বলত তাদের
ধর্মীয় নিদানে পাগড়ির কোন স্থান নেই, তাহলে সেই যুক্তি ততক্ষণাত বাতিল হয়ে যেত।
ফলে আজকে যে
পাগড়িকে শিখদের ধর্মের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে দেখার কথা হচ্ছে, সেই চিহ্নটা তৈরি
হয়েছিল ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্বার্থ রক্ষায়। ঠিক যেভাবে তারা ভারতের নানান গোষ্ঠীকে
উপনিবেশ রক্ষার স্বার্থে গড়ে পিটে নিয়েছিল, শিখেরাও ব্রিটিশদের একটা নির্দিষ্ট
ভূমিকা পালন করে গিয়েছে মন দিয়েই। শিখদের কাছে ব্রিটিশদের চাহিদা ছিল মন দিয়ে
সেনার ভূমিকা পালন করা এবং উপনিবেশ, শিখ ধর্মকে যোদ্ধাদের ধর্ম হিসেবে লালল পালন
করে গিয়েছে। অষ্টাদশ শতকের ইওরোপিয় সেনাবাহিনীতে এক পোষাক চালু হল যেখানে একই
পদের, একই এককের সেনারা প্রত্যেকে একই রকমভাবে দেখতে হবে, যার মাধ্যমে তারা
শৃঙ্খলা এবং বশ্যতা স্বীকার করে একই কমাণ্ডের আদেশ পালন করবে। নির্দিষ্ট ধরণের
পাগড়ি যেটা পরবে শুধুই শিখেরা, যে রেজিমেন্ট হবে শুধুই শিখেদের নিয়েই, সেই পাগড়িই
শিখেদের পরিধেয়র অন্যতম অংশ হয়ে উঠল, যে চিহ্ন ব্রিটিশেরা তৈরি করল শিখেদের থেকে
অসীম আনুগত্য ও বশ্যতা স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে।
No comments:
Post a Comment