অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
কর্নেল ম্যাকেঞ্জি এবং অমরাবতীর মার্বেল পাথরের স্থাপত্য
উনবিংশ শতকের
প্রথমপাদের প্রত্যেকটি ব্রিটিশ যুদ্ধ এবং বিজয় স্মারক আর বিজয়চিহ্ন লন্ডনে গিয়ে হয়
রাজ পরিবারের টাওয়ার স্থিত অস্ত্রাগারে উপঢৌকন হিসেবে গিয়েছে নয় কোম্পানির ছোট্ট
মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছে – ড্রাগনের মত কামান রেঙ্গুন থেকে, মারাঠা যুদ্ধের
তরোয়াল, ঢাল আর ড্যাগারগুলি; অথবা শান্তির উপহার হিসেবে ভাবলে রবার্ট গিলের অজন্তা
গুহার ফ্রেস্কোগুলি। কোম্পানির মিউজিয়ামে ১৮৫৩ সালে বিজয় স্মারক হিসেবে সব থেকে
বেশি গুরুত্ব পেয়েছিল শিখ যুদ্ধের স্মারকগুলি – বিশেষ করে রঞ্জিত সিংহের স্বর্ণ
সিংহাসন এবং কোহিনুর, যা ব্রিটিশ রাজপরিবারের মুকুটে বসানো ছিল। গভর্নর জেনারেল
ভাবলেন, উদ্ধার হওয়া গুরু গোবিন্দ সিংহ ব্যবহৃত একটি করে হাতিয়ার এবং বল্লম শিখদের
ফিরিয়ে দেওয়া অবিবেচকের কাজ হয়ে যাবে, ফলে এটিও টাওয়ারের প্রদর্শনীতে পাঠানো হল। যুদ্ধে
উদ্ধার হওয়া অস্ত্রগুলি লন্ডনে পাঠানো হল এবং এগুলি শিখদের শৌর্য হিসেবে প্রদর্শিত
হল। এই অস্ত্রগুলির প্রত্যেটির কুলুজি আছে এবং রঞ্জিত সিংহের শিখজাতি তৈরির
হাতিয়ার এই অস্ত্রগুলি। ব্রিটিশেরা শুধু শিখদের ধর্মনিরপেক্ষ চিহ্নগুলি ধারন করতে
উৎসাহী হল তাই নয়, তারা গুরুগ্রন্থ হাতে পেতে এবং সেটি ইংরেজিতে অবিলম্বে অনুবাদ
করতে অতিউতসাহী হয়ে উঠল। ব্রিটিশদের ভারত ভূমিজয়ের এক একটি বিজয় সূচিত হল জ্ঞানের
ওপর বিজয়ে।
১৭৯৯ সালের
ব্রিটিশেরা তৃতীয় মহীশূর যুদ্ধে জেতায় ভারত থেকে সব থেকে জনপ্রিয়তম নিদর্শনগুলি
গেল। এই উচ্ছ্বাস শেষ হল আরেকটি ধামাকাদার ঘটনায়, সেটি হল সিপাহী যুদ্ধ। যুদ্ধটির
খবর লন্ডনে বিপুল উৎসাহের সৃষ্টি করল। বিপুল মানুষের অক্ষর জ্ঞান এবং চিত্রিত
পত্রিকার প্রতিবেদনিক ঘণঘটায় মুহূর্তের মধ্যে শত্রু আর নায়ক তৈরি হয়ে যাচ্ছিল – ‘পাণ্ডে’
বিদ্রোহী এবং অদ্ভুত আর রহস্যময় ব্রাহ্মণ, যিনি অন্যান্য যুদ্ধে যাওয়া চাষীদের
সঙ্গে নিয়ে বাংলা সেনার শিরদাঁড়া হিসেবেও দাঁড়িয়ে ছিলেন যারা তাদের অধীক্ষকদের
হত্যা করে তাদের নিরাপরাধ স্ত্রী আর শিশুদের রক্তে হোলি খেলে; বিদ্রোহীদের নেতা
জরাগ্রস্ত কিন্তু বিপজ্জনক ব্রিটিশ সম্রাট এবং অর্ধইওরোপিয় লম্পট মারাঠা ব্রাহ্মণ
নানা সাহিব। নায়কেরা নিকলসনের মত সক্কলে প্রতিশোধগ্রহনকারী খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী।
মাঠে নেমে যুদ্ধ করা জেনারেল নেইল এবং মেজর হডসন এবং অতিরক্ষণাত্মক জেনারেল নেইল
এবং মেজর হ্যাভকল এবং আউট্রাম অবিসংবাদী নায়ক। আরও ছিল এংলো
ইন্ডিয়ান পোস্ট এন্ড টেলিগ্রাফ দপ্তরের কর্মচারী কানিভায়ুগ(Kavinaugh), যাকে প্রথম অশ্বেতাঙ্গ হিসেবে ভিক্টোরিয়া
ক্রস স্মারক তুলে দেওয়া হয়। আর ছিলেন জেনি, একজন সাধারণ সেনার কন্যা, যার লক্ষ্ণৌ
নিয়ে স্বপ্ন খাতায় কলমে রূপদান করেন টেনিসন এবং অন্যান্যরা আঁকায়, চিত্রে এবং সেরামিক্সে।
সিপাহী যুদ্ধের
সফলতা আবার নতুন করে লুঠের স্মৃতি হিসেবে নানান ভারতীয় কারিগরি লন্ডনের পানে ধাওয়া
করল। এই স্মতিচিহ্নগুলির নানান জনমহাফেজখানায় ঠাঁই হল। কিছু ঠাঁই পেল মেমোরেবিলিয়া
অব মিউটিনি হিসেবে ন্যাশনাল আর্মি মিউজিয়ামে যার মধ্যে ছিল দ্বিতীয় বাহাদুর সাহ
জাফরের ছোরা, মেজর হাডসনের কাছে ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সালে আত্মসমর্পন করা দিল্লির
রাজার শামসের এবং তলোয়ার; লর্ড অচিনলেকের দখল করা নানা সাহেবের তামার সুপুরিদানি; নাইন্থ
ল্যান্সারের সার্জেন্ট ব্রুকসএর হাতে পড়া কাঠের হাতা; যে গাছের আড়াল থেকে মেজর
হাডসন রাজকুমারীকে গুলি করে আহত করেন, সেই গাছের তৈরি টেবল, অযোধ্যার রাজার
ব্যবহৃত একটা পোর্সেলিনের পাত্র, লক্ষ্ণৌ অবরোধের সময় হেনরি লরেন্সের ব্যবহৃত ভাঙ্গাচোরা
পেয়ালা; লক্ষ্ণৌএর রূপোয় মোড়া ইট; তাঁতিয়া টোপির কুর্তা আর তাঁতিয়া টোপির নস্যি
ডিবে যেটায় তার চুল ছিল, জনৈক মৃত সৈনিকের থেকে লুঠ করা রূপোর আংটি, কানপুরের ‘গণহত্যা’য়
এক বাচ্চার জুতো; একই জায়গার একই সময়ে পাওয়া একটি ম্যানিকিওর সেট। এইগুলি ন্যাশনাল
আর্মি মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয়েছিল।
একজন বাঙালি এই প্রদর্শিত বস্তুগুলি কিভাবে দেখছেন?
রাখাল দাস হালদার ১৮৬২ সালে লন্ডনে পড়তে যান, তিনি ফিফ হাউসের প্রদর্শনী দেখে কি
লিখেছিলেন তা পড়া যাক - ইট ওয়াজ পেইনফুল টু সি দ্য স্টেট চেয়ার অব গোল্ড অব লেট
লায়ন অব দ্য পাঞ্জাব উইথ আ মেরি পিকচার আপন ইট; শলস উইদাউট বেবিজ; মিউজিক্যাল
ইন্সট্রুমেন্টস উইদাউট আ হিন্দু প্লেয়ার; জিলাইস এন্ড সোর্ডস উইদাউট সিপাহিজ এবং
সওয়ার্স; এন্ড এবভঅল হুকাজ উইদাউট ফিউম অব ফ্যান্টাস্টিক শেপস।
No comments:
Post a Comment