অধ্যায় ৪
উনবিংশ শতকে, বস্তুকে হস্তশিল্প, পুরাকীর্তি আর শিল্পে
রূপান্তর
এই অধ্যায়ে আমরা আলোচনা করব, কিভাবে একটি বস্তুকে গুণগতভাবে
স্মার চিহ্নে পরিবর্তন করা হয় এবং কিভাবে সেগুলির মূল্যমান নির্ধারিত আর অর্থ/মানে
যোগ করা যায়। পৃষ্ঠভূমি উনবিংশ শতকের ভারত আর ব্রিটেন।
হয়ত পোড়ামাটি, বা হাড়, হয়ত রংকরা কাগজ, হয়ত সূচীমুখ ধাতব
বস্তু, হয়ত মার্জিত চকচকে পাথর, অথবা একটি পালক ইত্যাদি যেসবগুলি প্রকৃতিতে পাওয়া
যায় সেগুলি মানবিক শ্রম দিয়ে পণ্যবস্তুতে রূপান্তর করে এবং প্রত্যেকটার সঙ্গে মানে/অর্থ
যুক্ত করে, তার ব্যবহাররের নির্দেশনা তৈরি এবং মান নির্দেশিত হল।
মাটির গর্ভ থেকে খুঁড়ে তোলা পোড়ামাটির পাত্রের খোলামকুচিতে
তারিখ আর অন্যকিছু লিখেটিকে আর হাজারো বস্তুর সঙ্গে প্রদর্শিত করে রেখে দিলে,
প্রত্নতাত্ত্বিকের কাছে সেটা ইতিহাসে রূপান্তরিত হয়। নির্দিষ্ট ভূতাত্ত্বিক এলাকায়
একটি হাড় খুঁজে পাওয়া গেলে সেটা হয়ে উঠল জীবাশ্মের অংশ এবং জীবাশ্মবিদের কাছে মানবের
বিবর্তনের অংশ। কেউ আবার বস্তুটাকে কামোদ্দীপক হিসেবে চিহ্নিত করলেন। বিছানার
চাদর, কিন্তু দুই পরিবারের মধ্যে আদান প্রদান হলে সেটা হয়ে উঠল আত্মীয়তার অংশ।
অতীতের কোন একজন প্রখ্যাত বীরের ব্যবহার করা সূচীমুখী একটি ধাতুর বস্তুকে তূণীরে
রেখে, গোটা একটা মনোবলহীন সৈন্যদলকে সেটা দেখিয়ে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করে তোলা
যায়। তার শত্রুদের কাছে এটা বিজয়চিহ্ন। ধর্মীয়গুরুর পরা কোন বস্ত্র প্রজন্মের পর
প্রজন্ম রেখেদেওয়াহয় গোষ্ঠী চিহ্নের নিদর্শন হিসেবে।
আমরা এখানে আরও একটা প্রশ্ন তুলছি(ভারতীয় কৃষ্টির
পৃষ্ঠপোষকদের) স্মারক/বস্তুর উতপাদন এবং তার মানে তৈরি করা হয়, অর্থাৎ বস্তুর
উতপাদকেদের থেকে সরে গিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় যে কাজটা করাচ্ছে বা অর্থ দিচ্ছে,
নিরাপত্তা দিচ্ছে, সমর্থন দিচ্ছে, এবং শ্রমের উতপাদন এবং ভাবনাকে ব্যবহার করছে তার
ওপরে। অক্সফোর্ড ইংরেজি শব্দকোষ(ওইডি) অনুযায়ী পৃষ্ঠপোষক(প্যাট্রন) সেই মানুষ, যে
কোন সংগঠন, উদ্দেশ্য বা কাজকে সমর্থন করে বা নিরাপত্তা দেয় এবং পৃষ্ঠপোষকতা হল,
ব্যবসায়িক বা দৈনন্দিন (কলোকুয়াল) ব্যবহার, যা ফিনানসিয়াল সাপোর্ট গিভন বাই
কাস্টমার্স ইন মেকিং ইউজ অব এনিথিং এস্টাব্লিশড, ওপেনড অর অফার্ড ফর দ্য ইউজ অব
দ্য পাবলিক।
ওইডিতে যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেটা তৈরি উনবিংশ শতকে। এই
অধ্যায়ে আমি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজনৈতিক অনুষঙ্গ হিসেবে পৃষ্টপোষণার বিষয়টি
ধরার চেষ্টা করব, যেখানে ব্রিটিশেরা ভারতীয়দের ওপর ক্রমগতভাবে তাদের মূল্যবোধ
চাপিয়ে দিয়েছিল। স্মারক/বস্তুগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক কিভাবে স্থাপিত,
আবিষ্কৃত, সংগৃহীত এবং শ্রেণীবিন্যস্ত হবে, সেটা ভারতের ইতিহাস খোঁজার ইওরোপিয়
প্রকল্প হিসেবে উঠে এল।
উনবিংশ শতকে ব্রিটিশেরা কর্তৃত্বপূর্ণ এবং নির্দেশপূর্ণ আর
কার্যকরী স্বরে ঠিক করে দিল, ভারতীয় ভৌগোলিক এলাকায় কিভাবে বস্তুগুলির মানে এবং
মূল্যমান নির্ধারিত হবে। এ ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকেরা স্মারক/বস্তুকে শ্রেণিবদ্ধ
জ্ঞানের পদ্ধতি তৈরি করে বলে দিলেন কোনটা কাজের, অতীতের কোন বস্তুকে স্মারক হিসেবে
সংরক্ষিত করতে হবে, কোনটা জাদুঘরে প্রদর্শিত করতে হবে, কোনটা বিক্রি করা যেতে
পারে, আর কোনটা ভারত আর ভারতের সম্পর্কের স্মারক হিসেবে বিদেশে চলে যাবে। বিদেশীরা স্মারকগুলোর একটা বাজার তৈরি করল, এবং
ঠিক করল কোনটা তাদের ঠিক করেদেওয়া মূল্যমানে বিক্রি হতে পারে। মোটামুটি বিংশ
শতাব্দের শুরুর সময়ে ভারতীয় স্মারকগুলির মানে, মূল্যমান ইত্যাদি নিয়ে যে পোলেমিক্স
আর আলোচনা শুরু হল জুড়ে তাতে দেখাগেল ভারতীয়রা শুধুই দর্শকমাত্র। যদিও এই আলোচনায়
হাতেগোনা কিছু ভারতীয় অনুপ্রবেশ ঘটাল, কিন্তু আলোচনার শর্ত, দৃষ্টিভঙ্গী আর বিষয়
নির্ধারণ করত ইওরোপিয়রা আর তাদের স্বার্থপ্রণোদনা।
No comments:
Post a Comment