অধ্যায়২
ব্রিটিশ ক্ষমতা আর ভারতীয় জ্ঞান
ভারতীয় ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং দর্শন-চিন্তাভাবনা বিষয়ে ব্রিটিশেরা তিনটে
উদ্দেশ্যমূলক প্রকল্প নেয়।
প্রাথমিকটি
হল ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান এবং
দর্শন-চিন্তাভাবনা নিয়ে আপত্তির নানান প্রশ্ন তোলার চেষ্টা। এবং ভারতীয় ভাষা
ব্যবহার করে কিম্ভুতকিমাকার ভারতীয়দের ব্যবহার, প্রথা, এবং কুসংস্কারগুলি ভালকরে বুঝে নেওয়া এবং তাদের উত্তমরূপে
শাসন করা আর যতটা পারা যায় তথ্য সংগ্রহ করে ভারতীয়দেরকে শান্ত করার চেষ্টা করা এবং
নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হল।
দ্বিতীয়
প্রকল্পটি হল প্রাচীন কালের প্রজ্ঞাগুলিই যেন ইওরোপিয়দের হাতে ‘আবিষ্কৃত’ এবং
উদ্ধার হল এটা বুঝিয়ে ছাড়া, ঠিক যেভাবে পঞ্চদশ এবং ষোড়শ
শতকে গ্রিক আর রোমিয় প্রজ্ঞান আর ভাবনাগুলি উদ্ধার করা হয়েছিল। গোটাটা একটা
ইওরোপিয় উদ্দেশ্যমূলক প্রকল্প যার মোদ্দা উদ্দেশ্য ভারত আর পশ্চিমের মধ্যে
নির্দিষ্ট যোগসূত্র টানা এবং প্রাচ্যের সভ্যতাকে আবিষ্কার ও নিরূপন করে সেগুলির
প্রগতি এবং বিলয় বিষয়ে চরিত্রায়ন করা।
তৃতীয় প্রকল্পটা হল বিজিত ভূমির পরাজিত সাহিত্যিক ও ধর্মীয়
নানান সঙ্গঠন ও বিশেষজ্ঞর পৃষ্ঠপোষণা করা – বিশেষ করে প্রাচ্যে যারা পুথি সংগ্রহ, লেখালিখিক’রে, মৌখিকভাবে, অভিকর শিল্পের মাধ্যমে, ছবি এঁকে ভাষ্কর্য করে, আচার আচরণ পালন করে এবং
অভিনয় করে যে জ্ঞান তথ্য বহন করছিল, সেই পরম্পরাগুলিকে বিজয়ী ইওরোপিয়দের আবিষ্কার আর সেগুলির
ওপর তাদের অধিকার চিহ্নিত করা। ভারতীয়দের চোখে যাতে এই বিজয় ও অধিকার আইনি লাগে
তার জন্য তারা বলল যে ইওরোপিয়রা যেহেতু এই পরম্পরার ভারতীয় জ্ঞান বহন করা বিশেষজ্ঞ
আর সঙ্গঠনগুলি সম্মান আর পৃষ্ঠপোষণা দিচ্ছে, সেগুলিকেও যেন ইওরোপিয় দৃষ্টিতে ভারতীয়রা সম্মান দিক। এই
সম্মান দেওনের যে ইওরোপিয় উদ্যমটাও যেন ভারতীয়দের চোখে আইনি বাধ্যতা অর্জন করে সে
বিষয়ে তারা সচেষ্ট হল।
এই তিনটি প্রকল্পের মুল্যমান নিয়ে দুই ক্ষমতাকেন্দ্রের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা
দিতে লাগল। একটি কেন্দ্র লন্ডনে অবস্থিত যেখানে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মালিক
বোর্ড অব ডিরেক্টর সঙ্গঠনের সর্বময় কর্তারা বসে আছেন। এবং একই সঙ্গে কোম্পানিকে
নিয়ন্ত্রণ করে বোর্ড অব কন্ট্রোল যেটি পার্লামেন্টের মঞ্জুরিপ্রাপ্ত সংগঠন, যাতে
ভারতের ওপরে সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা যায়। দ্বিতীয় কেন্দ্রটি ছিল ভারতে
বলা দরকার মূলত বাংলায় যেখানে তাদের অধস্তন কর্মীরা কিছু কলকাতায় গভর্নর জেনারেল
ইন কাউন্সিলে এবং আর কিছু মাদ্রাজ আর
বম্বেতে ভারতের ঔপনবেশিক নিগড় চালনার কাজ করছেন। লন্ডনের সঙ্গে কলকাতা মাদ্রাজ আর
বম্বের যে বিপুল দূরত্ব আর ভারত থেকে লুঠএর বখরা পাঠানোর দক্ষতায় তিন শহরের প্রবীন
আমলাদের ক্রমশঃ ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে ভারত কলোনির প্রশাসকেরা অনেকটা স্বাধীনভাবে
হোম গভর্নমেন্ট চালিয়েছে।
লন্ডন ইংরেজি শিক্ষাকে প্রাথমিকভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করত
সবসময়। বাস্তবে অধিকাংশ সময় দেখা যেত ইওরোপিয় জ্ঞানের নির্মানের অধিকার ছেড়ে রাখা
হয়েছে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল বা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কিছু পেশাদার
জ্ঞানীদের বেসরকারি কাজকর্মের সদিচ্ছার ওপরে। ভারতীয় জ্ঞান নথিকরণ, পৃষ্ঠপোষণ এবং
প্রচার দিয়ে ভারতে ঔপনিবেশিক শাসনের আইনি বৈধতা দেওয়ার যে বিতর্কিত পদ্ধতি হোম
গভর্নমেন্ট নিয়েছিল, সে বিষয়ে সম্পদ নিয়োজন, আর্থিক এবং সর্বোপরি ইওরোপের নিজস্ব
জ্ঞানচর্চার প্রচার ও প্রসারের সব থেকে ভালতম পদ্ধতি কি হতে পারে সে সবের নৈতিক
শর্ত নিয়ে দুই ক্ষমতা কেন্দ্রে বিপুল রাজনৈতিক এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক বিরোধ দেখা দিতে
শুরু করে।
No comments:
Post a Comment